সামাজিক জীব হিসাবে মানুষের সমাজবব্ধভাবে বসবাসের ইতিহাস বহু পুরোনো। বন, জঙ্গল, পাহাড়, গুহা, যাযাবর জীবন সব পেরিযে ক্রমবিকাশের ধারায় উৎকীর্ণ হয়ে আজ আলো ঝলোমল অত্যাধুনিক গ্লোবাল ভিলিজের বাসিন্দা। ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নামক বহতা নদীর তরঙ্গায়িত ধারায় বাঙালি জাতি সভ্যতা-সংস্কৃতির ইতিহাসে প্রায় আড়াই হাজার বছরের পথ অতিক্রান্ত করেছে। এই প্রবাহিত পথ পরিক্রমায় রয়েছে অনেক গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।
প্রাচীনকাল থেকে রয়েছে কিছু নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবাহী কিছু ব্যবহার্য জিনিসপত্র। যুগ যুগ ধরে আমরা এইসব সংস্কৃতি ধারণ-লালন হয়ে আসছে। হাজার বছর ধরে লালিত এই সকল জিনিস বাঙালি সংস্কৃতির এক একটি উপাদান ও ঐতিহ্যের স্মারকে পরিনত হয়েছে। সময়ের চাকা ঘুরে বদলায় সমাজ, বদলায় সংস্কৃতি এবং নিজস্বতা হারিয়ে আজ ধূসর বেলাভূমিতে বিলুপ্তির তালিকায় যুক্ত হচ্ছে।
এই আধুনিক যুগে আধুনিক সংস্কৃতি, পণ্য ও অত্যাধুনিক কলাকৌশলের প্রতিযোগিতায় আস্তে আস্তে বাঙালির অতীত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অনেক কিছু আজ অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। হারিয়ে যাওয়া বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ হলো বসবাসের জন্য ঘর। প্রাচীন কাল থেকে মানুষ বসবাসের জন্য তৈরি করতো ছনের ঘর, কাঠের ঘর, মাটির ঘর ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় ছিল ছনের ঘর। তাই বাংলা কবিতায় ছনের ঘর স্থান পেয়েছে যত্নের সাথে।
“ছন দিয়ে ঘর ছেয়েছি, বেঁধেছি ঘরের চালা,
ইখরের বেড়া বেধেছি, বাঁশের দিয়ে পালা।
মাটি দিয়া ভিটা ভরে, পিটিয়ে সমান করা,
গোবর মাটি এক করে, লেপা ঘরের বেড়া।”
গরিবের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর
গ্রামে প্রবাদ রয়েছে- ছনের ঘর নয়, এটা গরিবের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর। অর্থাৎ ছনের ঘরে বসবাসরতরা মনে করেন- অত্যন্ত খরতাপে ছনের ঘর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আবার শীতকালে অত্যন্ত ঠাণ্ডার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অনেক ধনাঢ্য পরিবার খরতাপ থেকে রক্ষা পেতে এবং চৈত্রের দুপুরে বিশ্রামের জন্য ছনের কাচারিঘর (বিশ্রামাগার) তৈরি করে ওখানেই দিব্যি আরাম-আয়েশে সময় কাটাতেন। কিন্তু গ্রামের হতদরিদ্র, দরিদ্র কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর একমাত্র আশ্রয় ছিল ছনের ঘর। বাঁশের খুঁটি এবং চাটাই কিংবা বাঁশের শলাকা দিয়ে তৈরি দোচালা বা চারচালা ঘরের ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করা হতো ছন। দুই বা তিন যুগ আগেও গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা মিলত ছনের ঘর। এখন আর দেখা মেলে না। কোনো কোনো পাহাড়ি এলাকায় মাঝেমধ্যে ছনের ঘর দেখা মেলে। ছনের ঘরে বাস করলে অত্যন্ত গরমেও অতিষ্ঠ হওয়ার বিড়ম্বনা থেকে যেমন রক্ষা পাওয়া যায়, তেমনি প্রচণ্ড শীতেও কনকনে ঠান্ডা থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়।
হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম ও হারিয়ে যাচ্ছে ছনের ঘর
কালের বিবর্তণ ও মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম। হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের নিশিথের আশ্রয় ছনের কুঁড়েঘর। এক সময় গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর গাছে পাকা আম, জাম, কাঁঠাল, কলা প্রভৃতি ফল-ফলাদিতে ভরপুর ছিল গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলো। এখন আর তেমনটি দেখা যায় না। দেখা যায় না চৈত্র মাসে অলস দুপুরে গ্রামের মেঠোপথের ধারে মাটিতে দাগ কেটে ৩২ কিংবা ৬৪ ঘুঁটি খেলা। খেলাধূলার মাধ্যমে সময় কাটানো বা বিনোদনের জন্য খেলাধূলার নানা উৎসবসহ বিভিন্ন প্রথা, রীতি-রেওয়াজ। দেখা মেলে না গ্রাম বাংলার দুঃখি মানুষের বসবাসের ঐতিহ্যবাহী প্রিয় ছনের ঘরও।
পরিবেশ বান্ধব ঘর তৈরির ছনের চাষ কমে যাচ্ছে
আধুনিকতার উৎকর্ষতায় বর্তমানে ছনের তৈরি ঘর বিলুপ্তির পথে। বেশিকাল আগে নেয়, যেখানে প্রতিটি গ্রামের দু’চারটি ছনের তৈরি ঘর চোখে পড়ত। বর্তমানে কয়েকটি ইউনিয়ন মিলেও এই ধরনের ঘর চোখে পড়েনা। এদিকে টিন, ইট অত্যধিক ব্যবহারের ফলে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। কারণ দেশে উৎপাদিত অধিকাংশ ইট পোড়ানো ও টিন পরিবেশ বান্ধব নয়। আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগেও গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ছিলো পরিবেশ বান্ধব ছনের ছাউনির ঘর। গ্রামে গ্রামে চাষ হতো বিপুল পরিমাণ ছন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অধিক শস্য-ফসলের প্রয়োজনে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ও জলবায়ু পরিবর্তনে কমে গেছে ছন চাষ।
ছন বিক্রি ও ঘর তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ
বন থেকে ছন কেটে কাঠুরিরা ছন বিক্রি করে সংসার চালাতো। ছনের ছাউনির ঘর তৈরির জন্য গ্রামে কিছু কারিগর ছিল যাদেরকে ছাফরবন্ধ নামে অভিহিত করা হতো। তারা বিশেষ কায়দায় ছনকে সাজিয়ে কয়েকটি ধাপের মাধ্যমে বাঁশ ও বেত দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ছনের উপর পানি ছিটাতো। যাতে করে সহজে ছনগুলো বাঁশের উপর বসে যায়। এভাবে তারা নান্দনিক ছনের ঘর তৈরি করতেন।
গ্রাম বাংলার চিরচেনা ছনের ছাউনি ঘরের প্রচলন দিনে দিনে কমে আসছে। আবহমান কালের গ্রামীণ ঐতিহ্যের ছনের ঘর যেমন আরামদায়ক তেমনি স্বাচ্ছন্দময়। এ ঘর নির্মাণ খরচও কম। বর্তমানে এই ঘর খুব একটা চোখে পড়েনা। হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালীর আজন্ম স্মৃতি চিহৃটি। হয়ত সেদিনটি খুব বেশি দূরে নয়; যেদিন ছনের ছাউনির ঘরের কথা মানুষের মন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। আর আগামী প্রজন্ম রূপকথার গল্পেই এই ঘরকে স্থান দিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করবে।
বাংলা৭১নিউজ/এবি