হঠাৎ যদি কাউকে বাম হাত দিয়ে লিখতে দেখেন; তাহলে অনেকেই অবাক হয়ে যান! শুধু তাই নয়, অনেকেই বাম হাত দিয়ে গাড়ি চালানো থেকে শুরু করে রান্না-খাওয়া সবই করতে পারেন। বিশ্বের অনেক মানুষই ডান হাতের জায়গায় বাম হাত ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। যারা বাম হাত দিয়ে কাজ করেন; তাদেরকে আমরা লেফটিস বা বাঁহাতি বলে সম্বোধন করে থাকি।
আজ আন্তর্জাতিক বাঁহাতি দিবস। প্রতিবছর ১৩ আগস্ট বিশ্বব্যাপী পালিত হয় এই দিবসটি। বাম হাতের ব্যবহার সম্পর্কিত নানা কুসংস্কার দূর করতে ও মানুষকে সচেতন করতে প্রতিবছর এ দিবস পালিত হয়। বিশ্বের সবদেশের বাঁহাদি মানুষরা এ দিবসটি বিভিন্নভাবে পালন করে থাকেন। আপনি যদি বাঁহাতি হয়ে থাকেন; তাহলে অবশ্যই আপনি ভাগ্যবান।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে ৯-২০ শতাংশ মানুষ বাঁ-হাতি। ইউরোপের ১৭টি দেশের মানুষের লেখার অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করে এক গবেষণায় বলা হয়, ২.৫-১২.৮ শতাংশ মানুষ বাঁ-হাতে লেখেন। আরেক গবেষণা মতে, বিশ্বে নারীর তুলনায় পুরুষ বাঁ-হাতির সংখ্যা বেশি।
প্রাচীনকাল থেকেই বাঁ-হাতিরা নানা অপবাদ ও বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন। যদিও বর্তমানে তা সচরাচর দেখা যায় না। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আজ্য বাঁহাতিদেরকে অবজ্ঞা করা হয়। একসময় সারা পৃথিবীতেই বাঁ-হাতিদের দুর্ভাগা ও বিদ্বেষপরায়ণ ভাবা হতো।
যেমন- রাইট শব্দের অর্থ ঠিক এবং ডান। শুধু এই যুক্তিতে প্রাচীন ইউরোপে বাঁহাতিদের অবহেলা করত। ল্যাটিন রাজদরবারে ব্যবহৃত শব্দ সিনিস্টারের অর্থ হলো বাম। আর এটিকে বিবেচনা করা হতো দুর্ভাগ্য আনার প্রতীক হিসেবে।
প্রাচীন মিসরে বাঁ-হাতিরা কখনোই পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করতে পারতেন না। ভারতীয় উপমহাদেশেও বাঁ-হাতিদের নিয়ে নানা ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ছিল। আধুনিক সময়ে এসেও বাঁ-হাতিদের নিয়মিতই পড়তে হয় বিভিন্ন সমস্যায়। নিত্যদিনের ব্যবহারের প্রায় সব সরঞ্জামই তৈরি করা হয় ডানহাতিদের ব্যবহার উপযোগী করে। এ সমস্যা সারাবিশ্বেই চলমান।
মানুষ কেন বাঁহাতি হয়?
গবেষকরা বাঁ-হাতি হওয়ার কারণ হিসেবে ৪০টির মতো জিন শনাক্ত করেছেন। আরেক গবেষণা অনুসারে, জন্মগ্রহণের সময় শতকরা ৭৫ ভাগ শিশুই বামহাতি হওয়ার বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়। তবে পরবর্তী সময়ে পরিবেশ ও জীবনযাপন পদ্ধতি মিলিয়ে শিশু ডানহাতিতে পরিণত হয়।
প্লজ জেনেটিকস জার্নালে প্রকাশিত ম্যাশবলের একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মানুষ বাঁহাতি হবে কি-না সেটা নির্ভর করে জীনের ওপর। এ কারণে বাবা-মা দুজনই যদি বাঁহাতি হন তাহলে তাদের সন্তানদের বাঁহাতি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
কেবল মানুষই নয়, অনেক পশু-পাখিও বাঁ-হাতি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়। এক গবেষণায় বলা হয়, অস্ট্রেলিয়ান ক্যাঙ্গারুরা সব বাঁ-হাতি। সেখানে বলা হয়, দ্বিপদী প্রাণীর ক্ষেত্রে হয়তো এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু চতুষ্পদ প্রাণীরা এ ধরনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে না।
বাঁহাতি হওয়ার যত সুবিধা
>> গবেষণায় দেখা গেছে, বাঁ-হাতিদের ডান পাশের মস্তিস্ক বেশি ব্যবহৃত হয়। এজন্যই সাধারণত বাঁ-হাতিরা বেশি উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকে। কারণ বাম হাতিরা মস্তিষ্কের ডান প্রকোষ্ঠের ব্যবহার বেশি করেন, যেখানে যুক্তি, কারণ ও সৃজনশীলতার বিষয়গুলো প্রক্রিয়াকরণ করা হয়।
>> ক্রিস এমসি ম্যামস ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডানহাতি ও বামহাতিদের ওপর লেখা একটি বইতে উল্লেখ করা আছে, বাঁ-হাতিদের জীবনের সাফল্য, প্রাপ্তি বা কৃতিত্বপূর্ণ কাজ, ডানহাতিদের তুলনায় ঈর্ষণীয়।
>> ক্রীড়াজগতে ক্রিকেট, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, বেসবল খেলায় বাঁ-হাতিরা বেশ সুবিধা আদায় করে নিতে পারে। এমন অনেক খেলোয়ার আছেন বিশ্বে।
>> ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের সফল রাজনীতিবিদদের অনেকেই বাঁ-হাতি।
>> গর্ভাবস্থায় এবং প্রসবের সময় সন্তানের অবস্থান এবং প্রিম্যাচিউর হলে বামহাতি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
>> মা-বাবা দুজন বাঁ-হাতি হলে সন্তানদের শুধু শতকরা ২৬ জন বাঁ-হাতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
>> ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লাফায়েত কলেজ এবং জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখিয়েছেন, বাঁহাতিরা ডানহাতিদের চেয়ে ১০-১৫ শতাংশ বেশি উপার্জন করেন।
>> গবেষণার তথ্য অনুসারে, বাঁহাতিরা স্ট্রোক থেকে দ্রুত সেরে ওঠে। যদিও এ বিষয়টির সঠিক কারণ জানা যায়নি।
>> বাঁহাতিরা মাল্টিটাস্কার হয়ে থাকেন। অর্থাৎ তারা ডান হাতের কাজ বাম হাত দিয়ে সহজেই করতে পারেন। গবেষকরা দেখেছেন, বাম এবং ডান হাতের মানুষের মধ্যে যখন আলোচনা হয়; তখন বাম হাতের লোকেরা দ্রুত সাড়া দেয়।
>> বাঁহাতিরা সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিজ্ঞানীদের মতে, বাম হাতের লোকেরা যেকোনো কাজের আগে সময় নেয় এবং তারা পরিণতির কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত দেয়।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, বিশ্বের ধনী ব্যক্তি বিল গেটস, কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ মোজার্ট, চিত্রকর লিওনার্দো দি ভিঞ্চি, বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, দার্শনিক অ্যারিস্টটল, জনপ্রিয় অভিনেতা চার্লি চাপলিন, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব অপ্রা উইনফ্রে কিংবা খেলার মাঠের জাদুকর লিওনেল মেসি সবাই বাঁহাতি।
সূত্র: বিবিসি/টাইমস অব ইন্ডিয়া
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ