আগামী ফেব্রুয়ারি মাসেই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা অমর একুশে বইমেলা। কিন্তু করোনা পরিস্থতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সব আয়োজন। শঙ্কিত লেখক-প্রকাশ-পাঠকরা। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যদি ওমিক্রন এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে বইমেলা করা সম্ভব হবে না হয়তো। তবুও আশায় বুক বাঁধেন সাহিত্যকর্মীরা। বইমেলার কাছে অনেক প্রত্যাশা তাদের। সেসব শঙ্কা ও প্রত্যাশা নিয়েই আজকের আয়োজন—
কবি ও কথাসাহিত্যিক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল বলেন, ‘পৃথিবীটা এখন অসুস্থ। অসুস্থ পৃথিবীতে অনেক কিছুই অনিশ্চিত, এলোমেলো। বইমেলার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার পর বিশ্বের সব বইমেলা নষ্ট দুধের মতো হয়ে যাচ্ছে।
আমি পৃথিবীর প্রায় সব সেরা এবং শীর্ষ গ্রন্থমেলায় গেছি। কিন্তু আমাদের বাংলা একাডেমির বইমেলার সাথে কোনো মেলার তুলনা হয় না। একদিকে মাসব্যাপী বইমেলা একমাত্র আমাদের ফেব্রুয়ারি বইমেলা এবং তা সত্যিকার অর্থেই প্রাণের বইমেলা।
বন্ধু রিটনের ভাষায় বলতে চাই, আমার জীবনে যদি উৎসব থাকে কোনো, তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব হচ্ছে বইয়ের উৎসব। এই সময়টার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকি সারাবছর। আমি ১২ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দূরের দেশ থেকে উড়ে আসি এই দেশে শুধু এই বইমেলার জন্য এই সময়টায়। আমি থাকি কানাডায়।
বরফ প্লাবিত একটা দেশ, আমি অপেক্ষা করি… বইমেলার। কানাডায় আসার পর প্রতিবছর বইমেলার টানে দেশে ছুটে আসি। কিন্তু গতবার বইমেলায় আসা হয়নি। আর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি বইমেলা হয়েছে মার্চ-এপ্রিলে। এই মেলার কোনো দরকার ছিল না। অযথা অর্থ অপচয় হয়েছে।
এবারও একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে। বাড়ছে ওমিক্রন। শঙ্কিত করে তুলছে সবাইকে। দেশে যাওয়ার জন্য টিকিট বুকিং দিয়েও বাতিল করে দিলাম। ২ জানুয়ারি বিশ্বব্যাপী প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। কখন কোন পরিস্থিতি হয়, বলা কঠিন! অথচ বইমেলার জন্য মনটা ছটফট করছে। বইমেলায় আমার পাঠশালার স্টল থাকে। নিজের বই বের হয় বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে। বন্ধু-বান্ধব, লেখকদের সাথে মিলনমেলা জমে। সর্বোপরি আমার আব্বা এবং আম্মাকে পাই প্রাণভরে।
ইতোমধ্যে কলকাতার বইমেলা স্থগিত করা হয়েছে। বাংলা একাডেমির বইমেলাও অনিশ্চিত। মন খারাপ! কী আর করার আছে? আমি মনে করি, আগে জীবন, আগে বেঁচে থাকা। তারপর অন্য কাজ। সেজন্য গতবারের মতো এলোমেলো বইমেলা না করে; বইমেলা বাতিল করাই ভালো!’
কবি ও কথাসাহিত্যিক ইমরুল ইউসুফ বলেন, ‘চোখের সামনেই বইমেলা বদলে যেতে দেখলাম। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে পায়ে পায়ে রাস্তা পেরিয়ে বইমেলা চলে গেল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মিলিয়ে বইমেলার এখন বিশাল পরিসর।
আকাশের মতো। সমুদ্রের মতো। মন আকাশের প্রসার ঘটায় বই। পড়া ভালো কোনো বই আমাদের আনন্দের সাগরে ভাসায়। আমাদের জাগায়। আমাদের উজ্জীবিত করে। একবছর পর প্রাণ যেন প্রাণ খুঁজে পায়। কিন্তু কোভিডের কারণে গতবছর থেকে বইমেলার মন খারাপ।
এবছরও বইমেলার প্রাণে ওমিক্রনের চোখরাঙানি। তারপরও প্রত্যাশা বইমেলা যথাসময়ে শুরু হবে। ভাষা শহীদদের স্মরণে অমর একুশে বইমেলা বর্ণিল আলো ছড়াবে। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে লেখক-প্রকাশক-পাঠকদের মন আনন্দে ভরে উঠবে। নতুন বইয়ের ঘ্রাণে, প্রাণে ছোঁবে ভালোবাসার রং।
সূর্যের সাতরঙে ভেসে যাবে সকল শঙ্কা। বইমেলার পাশাপাশি আমার প্রাণেও বাজবে আনন্দের ডঙ্কা। কারণ বইমেলায় আমার ‘সাতরঙা আইসক্রিম’, ‘মিলিয়ে নাও তোমার হাতের ছাপ’, ‘নানা বাড়ির ছানা ভূত’ এবং ‘যুদ্ধে খেলা’—এ চারটি বই প্রকাশিত হবে। হরেক রং আর ছবিতে মিশে থাকা বইগুলো পাঠককে আনন্দ দেবে। নব ভাবনার খোরাক জোগাবে।’
প্রতিদিনের সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক কবি মীর হেলাল বলেন, ‘লিটলম্যাগের দায়িত্বশীলরা এখন বইয়ের প্রকাশক হয়ে যাচ্ছেন। স্টলে অন্য প্রকাশনীর বইও এনে রাখেন। লিটলম্যাগ কর্নারে গেলে মনে হয়, বইয়ের স্টল। বইয়ের ভিড়ে লিটলম্যাগের ‘আর্তনাদ’ চোখে পড়ে।
তাই লিটলম্যাগ কর্নার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। বই প্রকাশকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে লিটলম্যাগের মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আগে বছরে কয়েকটি লিটলম্যাগ বের হলেও অধিকাংশই শুধু মেলাকে কেন্দ্র করে সংখ্যা করেন। এতে আমরা লিটলম্যাগ আন্দোলন থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। লিটলম্যাগের দাবি তো এটা নয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের উচিত, লিটলম্যাগ কর্নারে বই বিক্রি নিষিদ্ধ করা।’
তরুণ কবি ও প্রাবন্ধিক জাকারিয়া জাহাঙ্গীর বলেন, ‘অসাধু কিছু প্রকাশক কাম মেলা-ব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে প্রতিবছর অনেক নতুন লেখক প্রতারিত হন। সাধনার পাণ্ডুলিপিটি মৌসুমী প্রকাশকদের হাতে তুলে দিয়ে একদিকে অর্থ অন্যদিকে পাণ্ডুলিপি হারিয়ে অঙ্কুরেই ঝরে যায় অনেক সম্ভাবনা। বাংলা একাডেমিকে এসব ব্যাপারে তদারকি ও আইনগত ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। লেখক-পাঠক-দর্শনার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্পটে ‘অভিযোগ বাক্স’ স্থাপন করা দরকার।
নতুন প্রকাশিত বই সম্পর্কে মাইক্রোফোনে যে ঘোষণাটি দেওয়া হয়; তা ডিজিটাল পদ্ধতিতে করা দরকার। ঘোষণার সাথে সাথে দু-তিনটি বড় স্ক্রিনে বইয়ের প্রচ্ছদ, লেখকের ছবি, স্টল নম্বর ও নাম প্রদর্শিত হলে পাঠকদের জন্য বই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সুবিধা হয়। মেলা প্রাঙ্গণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে বিশেষ মনিটরিং করতে হবে। যারা পরিবেশ নোংরা ও আইন অমান্য করবে, তাদের সাথে সাথেই আইনের আওতায় আনতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
জরিমানা হিসেবে নগদ টাকার পরিবর্তে নির্ধারিত অঙ্কের বই কিনতে বাধ্য করা যেতে পারে। মেলার মূল প্রাঙ্গণ থেকে খাবার হোটেলগুলো সরিয়ে আলাদা বাউন্ডারির মধ্যে রাখলে পরিবেশ সুন্দর হবে। হোটেলগুলোতে দামি খাবার তৈরি করায় গ্রামাঞ্চল থেকে আসা ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য হয়—বিধায় দেশি খাবার প্রস্তুত ও মূল্য তালিকা টাঙানো বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সর্বোপরি বইমেলাকে আরও প্রাণবন্ত ও সার্থক করতে বাংলা একাডেমিকে প্রচারণামূলক ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর কয়েকটি ক্যাটাগরিতে নবীন লেখক পুরস্কার ও পাঠকদের জন্য ‘বুক রিভিউ’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করলে বইমেলায় মানুষের আগ্রহ আরও বাড়বে।’
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ