বাংলা৭১নিউজ,(বরিশাল)প্রতিনিধি: ‘আমি দেশের কাছে, জনগণের কাছে বিচার চাচ্ছি। এখানের (লঞ্চঘাট) এক মেডিসিন ব্যবসায়ী জনির স্ত্রী আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। তার অভিযোগের ভিত্তিতে কোনো চিন্তা-ভাবনা না করে এখানের (লঞ্চঘাট) দোকানদাররা আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কেড়ে নিয়ে আমাকে শেষ করে দিয়েছে। আপনারা আমাকে বাঁচান।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক লাইভে এসে নিজেকে বাঁচানোর এমন আর্তনাদ জানানোর এক ঘণ্টার মধ্যে বরিশালে শিরিন খানম নামে এক নারী ওষুধ ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। তবে ওই নারীর স্বজনদের দাবি, তাকে হত্যা করা হয়েছে।
ফেসবুক লাইভে এসে শিরিন খানম বলেন, ‘লঞ্চঘাটের মেডিসিন ব্যবসায়ী জনির স্ত্রী আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। তার অভিযোগের ভিত্তিতে লঞ্চঘাটের দোকানদাররা আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কেড়ে নিয়ে আমাকে শেষ করে দিয়েছে। ওপরের লোকরা সকালে এক কথা বিকেলে আরেক কথা বলে। রনি মেডিসিন হাউজের রনি বলেছেন জনির স্ত্রী আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন। এজন্য আমার দোকান কেড়ে নিয়েছে লঞ্চঘাটের দোকানদাররা। দোকান উচ্ছেদ না করার জন্য আমি তাদের হাত-পা ধরে কান্না করেছি। সচী মেডিকেলের মালিক এই এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলরের হাত-পা ধরেছি অনেক বার। তাকে বলেছি ভাই আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রক্ষা করেন। আমাকে বাঁচান, আমার কি দোষ। কিন্তু আমার কথা শোনেননি কাউন্সিলর।’
ফেসবুক লাইভে আর্তনাদ করে শিরিন খানম বলেন, ‘কেউ আমাকে কিংবা আমার প্রতিষ্ঠান বাঁচানোর চেষ্টা করেনি। জোর করে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কেড়ে নিয়েছে তারা। তাদের কাছে আমি বার বার লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। যার প্রমাণ আমার ব্যাগে আছে। লঞ্চঘাটের ব্যবসায়ী কায়েস মিয়া, রনি আর জনির স্ত্রী এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিলে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শেষ করে দিয়েছে। ১ নভেম্বরের মধ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান না ছাড়লে জোর করে দোকানে তালা দেবে বলেছে তারা। আমারে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দিয়েছে।’
জনি ও জনির স্ত্রী, রনি এবং ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সচী মেডিকেলের মালিক কায়েস মিয়ার বিচারের দায়িত্বভার আমি আপনাদের কাছে দিয়ে গেলাম। এই কজন মিলে আমার জীবনটা শেষ করে দিলো। আমারে বাঁচতে দিলো না তারা। এদের অত্যাচারে আমি শেষ। আমি এর বিচার জনগণের কাছে দিয়ে গেলাম। জনগণ এর বিচার করবে। আমি সেই আশায় রইলাম।
ফেসবুক লাইভে এসে এভাবেই কথাগুলো বলেছিলেন বরিশাল নগরীর বান্দরোড লঞ্চঘাট সংলগ্ন শিরিন মেডিকেল হলের মালিক শিরিন খানম। রোববার রাত ৯টা ৪ মিনিটে ফেসবুক লাইভে ২ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের ভিডিওটি শিরিনের জীবনের শেষ ভিডিও। কারণ রাত ১০টার দিকে তার মৃত্যু হয়। তবে তার মৃত্যুর সঠিক কারণ বলতে পারছে না পুলিশ।
শিরিনের স্বজনরা বলছেন, শিরিনকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় শিরিনের ভাই ইউসুফ মৃধা বাদী হয়ে সোমবার সকালে কোতোয়ালি থানায় আটজনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত তিন-চারজনকে আসামি করে মামলা করেছেন।
শিরিনের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায়। বরিশাল নগরীর ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোডের মো. হুমায়ুনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। তাদের এক ছেলেসন্তান রয়েছে। তবে তাদের সংসার বেশি দিন টেকেনি। পারিবারিক কলহের কারণে তাদের বিচ্ছেদ হয়।
এরপর শিরিন নিজের রোজগারের পথ খুঁজতে থাকেন। দেড় বছর আগে বরিশাল নগরীর বান্দরোড স্টিমারঘাট জামে মসজিদ মার্কেটে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে ফার্মেসি দেন শিরিন। দোকানের নাম দেন শিরিন মেডিকেল হল। থাকতেন নগরীর ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোডের একটি ভাড়া বাসায়।
স্থানীয়রা জানান, কিছুদিন আগে শিরিনের নামে জনি নামের এক ব্যক্তির স্ত্রী মসজিদ কমিটির কাছে অভিযোগ দেন। অভিযোগে শিরিনকে চরিত্রহীন বলে উল্লেখ করা হয়। শিরিনের সঙ্গে জনির অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
ওই এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর এটিএম শহীদুল্লাহ কবির বলেন, ‘আমি ওই দোকানের মালিক নই। দোকানের মালিক স্টিমারঘাট জামে মসজিদ কমিটি। দোকান ছেড়ে দেয়ার নোটিশ হাতে পেয়ে শিরিন আমার কাছে এসেছিলেন। তাকে আমি বলেছি মসজিদ কমিটির সঙ্গে কথা বলতে। এখানে আমার কিছুই করার ছিল না।’
মসজিদ কমিটির সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, কমিটির কাছ থেকে দোকান ভাড়া নিয়েছিলেন ওই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি হুমায়ুন কবির প্রিন্স। শুনেছি শিরিনকে হুমায়ুন কবির দোকান ভাড়া দিয়েছিলেন। মুসল্লিরা নানা সময়ে কমিটির কাছে অভিযোগ করে আসছিলেন।
মুসল্লিদের অভিযোগ, নামাজের সময় ওই দোকানে উচ্চশব্দে গান বাজানো হতো। ওই নারীর চলাফেরায় শালীনতা ছিল না। দোকানে আড্ডা চলতো সবসময়। এসব কারণে দোকানের মূল ভাড়াটিয়া হুমায়ুন কবির প্রিন্সকে লক্ষ্য রাখতে বলেছিল মসজিদ কমিটি। তা না পারলে প্রিন্সকেই দোকান চালাতে বলা হয়েছিল। সে যেন অন্য কাউকে দিয়ে দোকান না চালায় এমন কথা মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল।
স্থানীয়রা জানান, রোববার রাত ১০টার দিকে নিজের ওষুধের দোকানে অসুস্থ হয়ে পড়েন শিরিন খানম। তাকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
জানা যায়, রোববার রাত ৯টা ৪ মিনিটে ফেসবুক লাইভে আসেন শিরিন। সেখানে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন। এমনকি কে কে শিরিন ফার্মেসি উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করেছেন তাদের নাম প্রকাশ করেন তিনি। রাতেই ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। তবে শিরিনের মৃত্যুর পর তার ফেসবুক আইডি কয়েক ঘণ্টা ডিঅ্যাকটিভ করে রাখা হয়েছিল। ফেসবুকে কখনো লাইভে এসে আবার কখনো স্ট্যাটাস দিয়ে শিরিন তার সমস্যার কথা তুলে ধরেছিলেন। এ কারণে সে সব প্রমাণ নষ্ট করতে হয়তো শিরিনের আইডি ডিঅ্যাকটিভ করা হয়েছিল।
কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের ওসি মো. নুরুল ইসলাম বলেন, এটি হত্যা না আত্মহত্যা তা বলা সম্ভব নয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে নিশ্চিত করে বলা যাবে। এ ঘটনায় শিরিনের ভাই ইউসুফ মৃধা মামলা করেছেন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে পুলিশ বেশ কয়েকটি বিষয়কে সামনে রেখে প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে তদন্ত শুরু করেছে।
ওসি মো. নুরুল ইসলাম বলেন, শিরিনের ফেসবুক থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তার আইডির প্রতিটি লাইভ ভিডিও, স্ট্যাটাস, কমেন্ট, শেয়ার বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। সেই সঙ্গে আসামিদের ধরতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
বাংলা৭১নিউজ/পিআর