দশ সহস্রাধিক মানুষের হৃদপিন্ডে বাইপাস সার্জারি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা কার্ডিয়াক সার্জন ডাক্তার লুৎফর রহমান। তাকে দেশে বিডিং হার্ট সার্জারির পথিকৃত বলা হয়ে থাকে। তার সমসাময়িক চিকিৎসকরা হৃৎপিণ্ড থামিয়ে বা অচল করে সার্জারি করতেন। রোগীর জন্য দশ বারো ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন হত। ডাক্তার লুৎফর রহমান হার্ট সচল রেখে অস্ত্রোপচার শুরু করেন। অনেক রোগীর রক্তের প্রয়োজন হতো।
সব শুরুর একটা গল্পটা থাকে। ইতিহাস ধরে রাখার উদ্যোগ ছিল না বলে বাংলাদেশে ওপেন হার্ট সার্জারির শুরুর গল্পটা হারিয়ে যেতে বসেছে।অধ্যাপক এস আর খান এবং অধ্যাপক নবী আলম খান দেশে হৃদপিন্ডে প্রথম অস্ত্রোপচার করেছিলেন। অধ্যাপক নবী আলম খান মারা গেছেন সম্ভবত ২০০৭ সালে।
ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাস করে এস আর খান ইংল্যান্ডে যান চিকিৎসায় উচ্চতর ডিগ্রি ও দক্ষতা অর্জনের জন্য। বয়সে কিছুটা বড় ছিলেন অধ্যাপক নবী আলম খান। তিনিও তখন ইংল্যান্ডে ছিলেন। দুজনেই হৃদরোগ ও হৃদরোগের শল্যচিকিৎসার ওপর উচ্চতর ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণ নেন।
১৯৭৮ সালে পরিবারের চার সদস্যকে নিয়ে ১১টি দেশের ওপর দিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে ১৯ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ২২টি সীমান্ত অতিক্রম করে ২৮ ডিসেম্বর দেশে ফেরেন এই বরেণ্য চিকিৎসক। দেশে ফিরে যোগ দেন সরকারের বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটে। এক বছর পর অধ্যাপক নবী আলম খান দেশে ফিরে তৎকালীন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে (এনআইসিভিডি) যোগ দেন।
নবী আলম খানের নেতৃত্বে ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশের প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। ইনস্টিটিউটটি এখন একেবারে আলাদা বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। নতুন নাম জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট (এনআইসিভিডি)।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল বা এনআইসিভিডি কারও কাছেই দেশের প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারির বিস্তারিত তথ্য নেই। তবে প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারিতে কার্ডিয়াক সার্জনদের সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন অধ্যাপক নাসির উদ্দীন আহমেদ। কার্ডিয়াক সার্জারিতে তিনি দেশের প্রথম স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী চিকিৎসক। এনআইসিভিডি থেকে অবসর নিয়ে বেসরকারি আয়েশা মেমোরিয়াল কার্ডিয়াক হাসপাতালের প্রধান কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে কাজ করছেন। প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারির রোগীর নাম ছিল মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। ১৯৮১ সালে মোস্তাফিজুর রহমান সাতকানিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র ছিলেন। তাঁর হৃৎপিণ্ডের ছিদ্র ওপেন হার্ট সার্জারির মাধ্যমে ঠিক করা হয়েছিল।
প্রথম অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত হার্ট-লাং যন্ত্রটি জাপান সরকারের সহায়তায় আনা হয়েছিল। আর পারফিউসনিস্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন একজন জাপানি নাগরিক। নার্সদের বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছিল। ‘অত্যন্ত সফল ছিল দেশের প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি।’
‘ওপেন হার্ট সার্জারির শুরুটা ভালো হওয়ায় এই বিশেষায়িত চিকিৎসা দেশে বেশ ভালোভাবেই প্রসার লাভ করেছে। প্রথম দিকে
হৃৎপিণ্ড থামিয়ে অস্ত্রোপচার করা হতো। এখন হৃৎপিণ্ড সচল রেখেই অস্ত্রোপচার করা হয়।
এ দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার মানুষের সফল ওপেন হার্ট বা বাইপাস সার্জারি হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দেশে সরকারি-বেসরকারি ২২টি হাসপাতালে বর্তমানে ওপেন হার্ট সার্জারি হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত শল্যচিকিৎসক আছেন প্রায় ১০০ জন। ওপেন হার্ট সার্জারি করতে এখন কম মানুষই দেশের বাইরে যান।
হৃদরোগের সব ধরনের চিকিৎসা এখন দেশে হচ্ছে। হৃদপিন্ডে জন্মগত ছিদ্র বন্ধ, বাইপাস সার্জারি, ভাল্ব স্থাপন, পেসমেকার স্থাপন।
বিশ্বের আধুনিক প্রায় সব প্রযুক্তিই এ দেশের চিকিৎসকেরা ব্যবহার করছেন। এখন অপেক্ষা হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের।
এক ব্যক্তির হৃৎপিণ্ড অন্যের শরীরে জুড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন হৃদরোগ শল্যচিকিৎসকেরা। হৃৎপিণ্ড দেওয়ার জন্য দেশের মানুষের প্রস্তুতি দরকার।
বাংলা৭১নিউজ/সূত্র: সিনিয়র সাংবাদিক আবুল হোসেনের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেওয়া