পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের অধিনস্থ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো ) এর কাজের ব্যয় কিভাবে কমানো যায় তা নিয়ে আলোচনা চলছে। অধিকাংশের মত হচ্ছে স্টোন চীপস আমদানি বন্ধ এবং পিপিযুক্ত জিও ব্যাগের পরিবর্তে নন পিপিযুক্ত জিও ব্যাগ ব্যবহার কবরা হলে ব্যয় অর্ধেকে নেমে আসবে। প্রতি বছর ভারত থেকে স্টোন চীপস আমদানি এবং পিপিযুক্ত জিও ব্যাগ ব্যবহারের কারণে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে।
জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা ভারতের হাতে তুলে দিতে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন ব্লক বানানোর নামে স্টোন চীপস আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন মহাপরিচালক, প্রভাবশালী কর্মকর্তা কাজী তোফায়েল আহমেদ সহ কতিপয় কর্মকর্তা এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পক্ষে সাফাই গান। এতে করে আওয়ামী শাসনামলের গত ১৫ বছরেই ভারত থেকে স্টোন চীপস আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ১৫শ’ কোটি ডলারেরও অধিক। এতে করে আমদানির নামে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হয়েছে, তেমনি পাউবোতে আওয়ামী ব্যবসায়ীরা অধিক মূল্যে এসব স্টোন চীপস আমদানি করে সরকারি অর্থের লাগামহীর অপচয় করেছে। সরকারের প্রতিটি বিভাগের দাায়িত্ব যেখানে ব্যয় সাশ্রয় করা, সেখানে পাউবো’র এক শ্রেনীর কর্মকর্তা নিজেদের আখের গোছাতে এই ব্যয় বৃদ্ধিকে সমর্থন জুগিয়ে গেছেন।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন নদী তীর প্রতিরক্ষামূলক কাজের জন্য সি.সি ব্লক নির্মাণ করতে হয়। ১৯৭৮ সাল থেকে ইটের খোয়া, বালু ১/২ ইঞ্চি থেকে ৩/৪ ইঞ্চি সিংগেলস দিয়ে সি.সি ব্লক নির্মাণ করা হতো। দেশের বড় বড় কাজ বিশেষ করে তিস্তা ব্যারেজের দুই তীর সংরক্ষণ কাজ, চাঁদপুরে নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ কাজ, সিরাজগঞ্জে হার্ড পয়েন্ট নির্মাণে দেশীয় সরঞ্জামাদি ব্যবহার করেই নদী তীর সংরক্ষণ করা করা হয়েছে। ২০১০ সালে নদী ভাঙ্গনরোধে ব্লক বানানোর জন্য ভারত থেকে স্টোন চীপস আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়। আমদানীকৃত স্টোন চীপস সিঙ্গেল/খোয়ার তুলনায় ৭০শতাংশ বেশি খরচ হয়।
জানা যায়, প্রতি বছর ভারত থেকে ১০ কোটি সিএফটি স্টোন চীপস ভারত থেকে আমদানি করা হয়। আর আমদানীকৃত স্টোন চীপস দিয়ে কাজ করার ফলে প্রতি সিএফটি ব্লক নির্মাণে অতিরিক্ত ১শ’ টাকার বেশি খরচ হয়। এভাবেই গত ১৫ বছরে স্টোন চীপস আমদানি বাবদ ১৫শ’ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। যা বৈদেশিক মুদ্রার সম্পূর্ন অপচয়।
এ ব্যপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক এক মহাপরিচালক জানান, অতিতে সিঙ্গেলস/ইটের খোয়া দিয়ে ব্লক বানানো হতো এবং নন পিপিযুক্ত প্লেইন জিও টেক্সটাইল ব্যাগে বালু ভর্তি করে ডিজাইনসম্মতভাবে ডাম্পিং করা হতো। এতে দেখা যেত, পরবর্তি বছর ওই ডাম্পিং ব্লক এর ওপর পলি/বালি পড়ে বিরাট চর উঠে গেছে। আর বর্ষায় লাখ লাখ সিএফটি পলি পড়ে ভরাট হওয়ার কারণে নদীর অন্যপারে চর ভেঙ্গে স্রোত বেড়ে যেত। এত করে, ডাম্পিংকৃত এলাকায় আর ভাঙ্গন দেখা দিতনা।
এ প্রসঙ্গে ওই কর্মকর্তা জানান, ২০০৬-০৭ আর্থিকবছরে ঠিকাদাররা এডিবি ফাইন্যান্সের অধিন পানি উন্নয়ন বোর্ড চাঁদপুর জেলার মতলব থানার ইরিগ্রেশন প্রজেক্টকে মেঘনা নদীর ভাঙ্গন হতে রক্ষার জন্য এবং পাবনা জেলার বেড়া উপজেলায় সিঙ্গেলস ও নন পিপিযুক্ত জিও ব্যাগ ডাম্পিং করেছিল। যা অদ্যাবধি পর্যন্ত অক্ষত আছে। এতে করে সেখানকার অবকাঠামো, মসজিদ, মন্দির, বাড়ীঘর, ফসলী জমি ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে।
এদিকে, জিও ব্যাগ নিয়ে ২০১০-১১ সালে আরও একটি হঠকারি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ড অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জানা যায়, ওই সময় কাজী তোফায়েলের সাথে কাতিপয় পাউবো কর্মকর্তা মিলিত হয়ে ২৫০ কেজি নন পিপি জিও ব্যাগে বালু ভর্তির পরিবর্তে পিপিযুক্ত জিও ব্যাগে বালু ভরে ডাম্পিং শুরু করে। এটা করা হয়, কতিপয় পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায়ীকভাবে লাভবান করার জন্য। এতে করে পাউবোর কাজে আর্থিক ব্যয় বৃদ্ধি পায়। প্রতিটি নন পিপিযুক্ত জিও ব্যাগের মূল্য যেখানে ১৮০ টাকা, সেখানে পিপি যুক্ত জিও ব্যাগের মূল্য ৩১০ টাকা। এতে করে গত ১৫ বছরে শত শত কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
এ ব্যপারে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক আমিরুল ইসলাম জানান, আমদানিকৃত স্টোন চীপস দিয়ে ব্লক তৈরি করলে টিকসই হয়। অতিতে যেভাবে ব্লক বানানো হতো তাতে ব্যয় কম হতো এটা ঠিক। তবে ব্লকের স্থায়ীত্ব হতো না। তবে আমরা পাউবো’র কাজের ব্যয় কমানো বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছি। তিনি বলেন, নন পিপিযুক্ত জিও ব্যাগ আরও অধিকহারে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটা হলে ব্যয় কমবে।
এ ব্যপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোঃ এনায়েত উল্লাহ জানান, আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভাঙ্গন প্রতিরোধ কাজের ব্যয় কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু জায়গায় আমরা পূর্বের অবস্থায় ফিরে গেছি। পর্যায়ক্রমে কম খরচে কিভাবে আরও উন্নতমানের কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়, তা নিয়ে পরিকল্পনা চলছে।
এ ব্যপারে ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস এম তাজুল ইসলাম এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘটনা সঠিক। পূর্বের পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে পানি উন্নয়নর বোর্ড সরকারি অর্থের ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। তিনি বলেন, নন পিপিযুক্ত জিও ব্যাগ দিয়ে যে কাজ করা সম্ভব; সেখানে অধিক মূল্যে পিপিযুক্ত জিও ব্যাগ ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কারো কারো ব্যক্তি স্বার্থে। তিনি ভারত থেকে স্টোন চীপস আমদানির বিরোধীতা করে বলেন, এতে করে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা ভারতে চলে গেছে। অথচ একই কাজ করা যেত, দেশীয় ইটের খোয়া/ সিঙ্গেলস ও নির্দিষ্ট বালু দিয়ে সি.সি ব্লক নির্মাণের মাধ্যমে।
তাজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে পাউবোতে কর্মরত ঠিকাদাররা নানা ধরণের জটিলতায় রয়েছে। বিশেষ করে নতুন কার্যাদেশ পাওয়ার পর রড, সিমেন্ট, পাথর, ইটের দাম বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে চুক্তিমূল্য রিভাইস না করার কারণে অসংখ্য ঠিকাদার ব্যাংকের কাছে দেউলিয়া হয়ে আছে। অথচ অতিরিক্ত কাজের রিভার্স পাওনা পরিশোধের বিধান থাকলেও পাউবো তা করছেনা। একইভাবে পাউবো কর্তৃক আরবিট্রেশনে যে সমস্ত কাজের বিল অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, নানা টালবাহানা করে পাউবো ঠিকাদারদের সেসব ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করছে না। তিনি ঠিকাদারদের এসব হয়রানির কবল থেকে রক্ষা এবং সরকারি অর্থ সাশ্রয়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় ও পাউবো মহাপরিচালতের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, পাউবোতে দুই ধরণের আইন চলছে। যেমন- ব্লক তৈরির স্যাম্পল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা করা হয়। এতে করে প্রায় এক হাজারের উপওে ব্লক নষ্ট হয়। এই ব্লকের অর্থ ঠিকাদারকে দেওয়া হয়না। এমনকি ব্লক পরীক্ষার ব্যয়ভার পর্যন্ত ঠিকাদারদের উপর চাপানো হয়। আবার বিদেশী ঠিকাদারররা এর ক্ষতিপূরণ পান। এতে করে দেশীয় ঠিকাদাররা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। সময় মত কাজের অর্থ না পাওয়ার কারনেও ঠিকাদাররা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। এসব বিষয়গুলো নিয়েও পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় ও পাউবোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ