#পাউবো’র দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করার দাবি
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো ) এর দায়িত্বহীনতা ও পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ ঠিকাদাররা মামলায় যাবেন। তাদের প্রত্যাশা স্বৈরশাসকের পতনের পর দেশে কাজের পরিবেশ সৃস্টি হয়েছে। আওয়ামী সরকারের লুটপাট, একশ্রেনীর ঠিকাদারের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে কাজ দেওয়া এবং দেশীয় সম্পদ ধ্বংস ও বৈদেশিক মুদ্রার লাগামহীন অপচয়ের খাত তৈরি করে দেশকে সঙ্কটে ফেলেছে যারা তাদের বিচারের সময় এসেছে। পাউবো’তে যারা আওয়ামী সরকারের দোসর হিসাবে কাজ করেছে তাদেরকেও চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এদের কারণে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে পাউবো-কে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্ষতিগ্রস্থ এক ঠিকাদার এভাবেই তার ক্ষোভের কথা তুলে ধরেছেন। এই ঠিকাদারের মতে, আওয়ামী দু:শানের ১৫ বছরে পাউবো’র যেসব কর্মকর্তা প্রকল্পের পিডি, প্রধান প্রকৌশলী, অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করে গেছেন এবং দায়িত্বে রয়েছেন-তাদের সম্পদের হিসাব নিলেই এই সেক্টরে কি পরিমান লুটপাট হয়েছে তার প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসবে।
জানা যায়, পাউবো-কে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের মত ব্যবহার করেছেন সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এবং সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় সচিব কবির বিন আনোয়ার। কবির বিন আনোয়ারের নামে দুই হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগও রয়েছে দূর্নীতি দমন কমিশনে। এছাড়াও পাউবো’র অর্থ তার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ইছাবেলায় ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। এছাড়াও নাম সর্বস্ব ঠিকাদার এবং আত্মীয়দের পাউবো’র বড় বড় ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দিতেন পানি সম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এবং সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় সচিব কবির বিন আনোয়ার। এভাবেই পাউবো’র হাজার হাজার কোটি টাকা আওয়ামী সরকারের আমলে দেশে-বিদেশে পাচার হয়েছে এবং চিহ্নিত একটি মহল সম্পদের বিশাল পাহাড় গড়ে তুলেছেন। তদুপরি, পাউবো-তে বঙ্গবন্ধু ইঞ্জিনিয়ার পরিষদের একচ্ছত্র দাপটের কারণে এই বোর্ডের অন্যরা ছিলেন একেবারেই কোনঠাসা। মন্ত্রী ও সচিব পাউবো’র কোন কিছু নিয়ন্ত্রন কিংবা কাউকে শায়েস্তা করতে হলে এই পরিষদকে ব্যবহার করতেন।
এদিকে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাউবো’র ব্যয় কমানো এবং আওয়ামী সরকারের আমলে ক্ষতিগ্রস্থ ঠিকাদারদের পুনর্বাসনের দাবি উঠেছে জোড়ালোভাবে। এ নিয়ে মামলার প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মদ্যে দিয়ে দু:শাসনের অবসান ঘটলেও পাউবো কর্মকর্তারা এখন পর্যন্ত ব্যয় সাশ্রয়ী প্রকল্প গ্রহণের ব্যপারে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাউবো’র এক কর্মকর্তা জানান, ভারত থেকে স্টোন চীপস আমদানি বন্ধ এবং পিপিযুক্ত জিও ব্যাগের পরিবর্তে নন পিপিযুক্ত জিও ব্যাগ ব্যবহার করার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন। তিনি ব্লক বানানোর নামে ভারত থেকে স্টোন চীপস আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন মহাপরিচালক, প্রভাবশালী কর্মকর্তা কাজী তোফায়েল আহমেদ সহ কতিপয় কর্মকর্তা এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পক্ষে সাফাই গান। এতে করে আওয়ামী শাসনামলের গত ১৫ বছরেই ভারত থেকে স্টোন চীপস আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ১৫শ কোটি ডলারেরও অধিক। এতে করে আমদানির নামে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হয়েছে, তেমনি পাউবোতে আওয়ামী ব্যবসায়ীরা অধিক মূল্যে এসব স্টোন চীপস আমদানি করে সরকারি অর্থের লাগামহীর অপচয় করেছে। সরকারের প্রতিটি বিভাগের দাায়িত্ব যেখানে ব্যয় সাশ্রয় করা, সেখানে পাউবোর এক শ্রেনীর কর্মকর্তা নিজেদের আখের গোছাতে এই ব্যয় বৃদ্ধিকে সমর্থন জুগিয়ে গেছেন।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন নদী তীর প্রতিরক্ষামূলক কাজের জন্য সি.সি ব্লক নির্মাণ করতে হয়। ১৯৭৮ সাল থেকে ইটের খোয়া, বালু ১/২ ইঞ্চি থেকে ৩/৪ ইঞ্চি সিংগেলস দিয়ে সি.সি ব্লক নির্মাণ করা হতো। দেশের বড় বড় কাজ বিশেষ করে তিস্তা ব্যারেজের দুই তীর সংরক্ষণ কাজ, চাঁদপুরে নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ কাজ, সিরাজগঞ্জে হার্ড পয়েন্ট নির্মাণে দেশীয় সরঞ্জামাদি ব্যবহার করেই নদী তীর সংরক্ষণ করা করা হয়েছে। ২০১০ সালে নদী ভাঙ্গনরোধে ব্লক বানানোর জন্য ভারত থেকে স্টোন চীপস আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়। আমদানীকৃত স্টোন চীপস সিঙ্গেল/খোয়ার তুলনায় ৭০শতাংশ বেশি খরচ হয়।
জানা যায়, প্রতি বছর ভারত থেকে ১০ কোটি সিএফটি স্টোন চীপস ভারত থেকে আমদানি করা হয়। আর আমদানীকৃত স্টোন চীপস দিয়ে কাজ করার ফলে প্রতি সিএফটি ব্লক নির্মাণে অতিরিক্ত ১শ’ টাকার বেশি খরচ হয়। এভাবেই গত ১৫ বছরে স্টোন চীপস আমদানি বাবদ ১৫শ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। যা বৈদেশিক মুদ্রার সম্পূর্ন অপচয়।
এদিকে, জিও ব্যাগ নিয়ে ২০১০-১১ সালে আরও একটি হঠকারি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ড অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জানা যায়, ওই সময় কাজী তোফায়েলের সাথে কাতিপয় পাউবো কর্মকর্তা মিলিত হয়ে ২৫০ কেজি নন পিপি জিও ব্যাগে বালু ভর্তির পরিবর্তে পিপিযুক্ত জিও ব্যাগে বালু ভরে ডাম্পিং শুরু করে। এটা করা হয়, কতিপয় পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায়ীকভাবে লাভবান করার জন্য। এতে করে পাউবোর কাজে আর্থিক ব্যয় বৃদ্ধি পায়। প্রতিটি নন পিপিযুক্ত জিও ব্যাগের মূল্য যেখানে ১৮০ টাকা, সেখানে পিপি যুক্ত জিও ব্যাগের মূল্য ৩১০ টাকা। এতে করে গত ১৫ বছরে শত শত কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
এ ব্যপারে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক আমিরুল ইসলাম ভূঞা জানান, আমদানিকৃত স্টোন চীপস দিয়ে ব্লক তৈরি করলে টিকসই হয়। অতিতে যেভাবে ব্লক বানানো হতো তাতে ব্যয় কম হতো এটা ঠিক। তবে ব্লকের স্থায়ীত্ব হতো না। তবে আমরা পাউবো’র কাজের ব্যয় কমানো বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছি। তিনি বলেন, নন পিপিযুক্ত জিও ব্যাগ আরও অধিকহারে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটা হলে ব্যয় কমবে।
এ ব্যপারে ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস এম তাজুল ইসলাম এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘটনা সঠিক। পূর্বের পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে পানি উন্নয়নর বোর্ড সরকারি অর্থের ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। তিনি বলেন, নন পিপিযুক্ত জিও ব্যাগ দিয়ে যে কাজ করা সম্ভব; সেখানে অধিক মূল্যে পিপিযুক্ত জিও ব্যাগ ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কারো কারো ব্যক্তি স্বার্থে। তিনি ভারত থেকে স্টোন চীপস আমদানির বিরোধীতা করে বলেন, এতে করে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা ভারতে চলে গেছে। অথচ একই কাজ করা যেত, দেশীয় ইটের খোয়া/ সিঙ্গেলস ও নির্দিষ্ট বালু দিয়ে সি.সি ব্লক নির্মাণের মাধ্যমে।
তাজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে পাউবোতে কর্মরত ঠিকাদাররা নানা ধরণের জটিলতায় রয়েছে। বিশেষ করে নতুন কার্যাদেশ পাওয়ার পর রড, সিমেন্ট, পাথর, ইটের দাম বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে চুক্তিমূল্য রিভাইস না করার কারণে অসংখ্য ঠিকাদার ব্যাংকের কাছে দেউলিয়া হয়ে আছে। অথচ অতিরিক্ত কাজের রিভার্স পাওনা পরিশোধের বিধান থাকলেও পাউবো তা করছেনা। একইভাবে পাউবো কর্তৃক আরবিট্রেশনে যে সমস্ত কাজের বিল অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, নানা টালবাহানা করে পাউবো ঠিকাদারদের সেসব ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করছে না। তিনি ঠিকাদারদের এসব হয়রানির কবল থেকে রক্ষা এবং সরকারি অর্থ সাশ্রয়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় ও পাউবো মহাপরিচালতের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, পাউবোতে দুই ধরণের আইন চলছে। যেমন- ব্লক তৈরির স্যাম্পল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা করা হয়। এতে করে প্রায় এক হাজারের উপওে ব্লক নষ্ট হয়। এই ব্লকের অর্থ ঠিকাদারকে দেওয়া হয়না। এমনকি ব্লক পরীক্ষার ব্যয়ভার পর্যন্ত ঠিকাদারদের উপর চাপানো হয়। আবার বিদেশী ঠিকাদারররা এর ক্ষতিপূরণ পান। এতে করে দেশীয় ঠিকাদাররা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। সময় মত কাজের অর্থ না পাওয়ার কারনেও ঠিকাদাররা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। এসব বিষয়গুলো নিয়েও পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় ও পাউবোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি বলেন, িআওয়ামী সরকারের আমলে পাউবো-কে যারা পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের মত ব্যবহার করেছে তাদের বিচার করতে হবে।
এ ব্যপারে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের সাবেক পরিচালক ও ব্যবসায়ী নেতা জামাত খান বলেন, পাউবো’র টাস্ক ফোর্সের কথিত আইন-কানুন কাজী তোফায়েল আহমেদের মনগড়া। তার বিরুদ্ধে সারাদেশ থেকে মামলা দায়ের হয়েছিল। আদালত তার কার্ডক্রম ৩ মাসের জন্য বন্ধের আদেশ দেন। পরবর্তিতে সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ওই আদেশ প্রত্যাহার করান। এর ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং দেশের উন্নয়মূলক কাজ বাধাগ্রস্থ হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নয় থেকে বারো নিউটিন / বর্গ মিলিমিটার এর কংক্রিট ব্যবহার করে। এই কনকর্ডে এর জন্য কখনোই স্টোন চিপস এর প্রয়োজন হয় না। এ ক্ষেত্রে ব্রিক চিপস অথবা দেশি স্টোন সিঙ্গলস বাবহারই যথেষ্ট । জিও ব্যাগ এর ক্ষেত্রে পিপি এর পরিবর্তে পিএস ব্যবহার করলে ফোর্টি পারসেন্ট অর্থ সাশ্রয় হবে । পানির নিচে পিএস ব্যাগ এর স্থাইত্য প্রায় শত বছর ।
পাউবো-কে ব্যয় সাশ্রয়ী প্রকল্প গ্রহণের তাগিদ দিয়ে জামাত খান বলেন, আমাদের দেশে টাস্ক ফোর্স গঠণ করা হয়েছে ব্যক্তি স্বার্থে। এতে করে প্রকৃত ঠিকাদাররা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আর এর সুফল নিয়েছেন চিহ্নিত আওয়ামী ঠিকাদারা। তিনি বলেন, আমরা ক্ষতিগ্রস্থ ঠিকাদাররা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইনশাআল্লাহ আমরা মামলায় জয়ী হবো।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচবি