মিশরে লুকিয়ে আছে হাজারও রহস্য। তেমনই একটি রহস্য হলো সেখানকার নারীরা পুরুষের বেশে রাজ্য শাসন করতেন। মিশরের শাসক বা রাজাদেরকে বলা হয় ফারাও। মিশরের রাজা বা ফারাওদের কথা সবাই জেনে থাকবেন।
তবে পুরুষের বেশে নারী ফারাওদের সম্পর্কে জানেন কি? যদিও মিশর শাসকদের বেশিরভাগই পুরুষ ছিলেন। তবে অনেক নারীরাও মিশরের ইতিহাসে ফারাও হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। মিশরের সমৃদ্ধিতে তাদের অবদানও অনেক।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, মিশরের তিন হাজার বছরের ইতিহাসে ১৭০ জন ফারাওয়ের মাঝে সাত জন ছিলেন নারী। তারা হলেন, সোবেকনেফেরু, হাতশেপসুত, নেফারতিতি আখামেননের, আনাক-সু-নামুন, নিতক্রিস, খেনকস প্রথম ও ক্লিওপেট্রা।
তবে ইতিহাসবিদদের মতে, নারী শাসকের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ অনেকের নামই ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। মিশরের নারী ফারাওদের ছিলো বর্ণাঢ্য জীবন।
জানা যায়, নারী ফারাওদের মধ্যে হাতশেপসুত পুরুষের বেশে রাজ্য শাসন করতেন। চলুন জেনে নেওয়া যাক তিনি কীভাবে নিজের পরিচয় গোপন করে শাসককার্য চালাতেন সে সম্পর্কে-
হাতশেপসুত ছিলেন মিশরীয় নারী ফারাওদের মধ্যে দ্বিতীয় এবং অন্যতম। প্রাচীন মিশরের অষ্টাদশ রাজবংশের পঞ্চম ফেরাউন ছিলেন তিনি। হাতশেপসুত অর্থ হলো ‘মহৎ নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ’।
প্রাচীন মিশরবিদরা তাকে সর্বাপেক্ষা সফল ফেরাউনদের একজন হিসেবে গণ্য করেন। মিশরীয় রাজবংশের অন্যান্য নারীদের থেকে তার রাজত্বকাল ছিল দীর্ঘতর। তিনি মিশরের অনেক উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করেছিলেন।
হাতশেপসুতের জন্ম হয় ১৪৯৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। একটি সিংহের গুহায় তার জন্ম হয়েছিলো বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। তিনি প্রথম থুতমোসের কন্যা এবং দ্বিতীয় থুতমোসের প্রধান স্ত্রী ছিলেন।
শাসক হিসেবে হাতশেপসুত ছিলেন বিচক্ষণ এবং সাহসী। যিশু খ্রীষ্টের জন্মের ১৫০০ বছর আগের প্রাচীন সময়ে তিনি মিশর শাসন করেন। হাতশেপসুত আনুমানিক ১৪৭৯-১৪৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পর্যন্ত সহ-শাসক হিসাবে মিশরে রাজত্ব করেন।
দীর্ঘ ২১ বছর নয় মাস শিশর শাসন করেন হাতশেপসুত। তার সময় অসাধারণ সব স্থাপত্য নির্মিত হয়েছে। তিনি পুরুষের পোশাক পরে সিংহাসনে বসতেন, এমনকি ফারাও এর নকল দাড়িও লাগাতেন।
তখনকার সময়ে দাফতরিকভাবে রাজা হলেও মুকুট ধরে রাখা আর রাজ্যের সবার শ্রদ্ধা পাওয়া কঠিন পরীক্ষা ছিল। বিশেষ করে একজন নারী হয়েও মিশরীয়দের মনে রাজার স্থান পাওয়া ততটা সহজ ছিলো না।
কোনো নারীকেই তখন মিশরীয়রা রাজা হিসেবে মেনে নেওয়া হতো না সহজে। হাতশেপসুত একদিকে যেমন ছিলেন অপরূপ সুন্দরী রমনী, তেমনি তার ছিলো অসাধারণ বুদ্ধিমত্তাও। তিনি এই সমস্যারও সমাধান করে ফেললেন।
সামাধান হিসেবে তিনি পুরুষের বেশে রাজ্য শাসন করতে শুরু করলেন। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সভাগুলোতে তিনি পুরুষদের পোশাক আর নকল দাড়ি পরতেন। এভাবে ধীরে ধীরে তিনি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করেন।
তবে হাতশেপসুত তার এই পুরুষালী বেশভূষা বা নকল দাড়ির জন্য ইতিহাসে বিখ্যাত হননি, হয়েছেন তার কর্মগুণে। মিশরীয় গবেষক জেমস হেনরির মতে, হাতশেপসুত ইতিহাসে উঠে আসা প্রথম মহৎ নারী।
মিশর শাসনকালে হাতশেপসুতের মূল লক্ষ্য ছিলো নতুন নতুন রাজ্যজয়ের পরিবর্তে নিজ রাজ্যকে সমৃদ্ধ করা। সে লক্ষ্য নিয়েও কাজ শুরু করেন তিনি। রাজকীয় স্থাপত্য, সমাধি, মন্দির তৈরীতেই তার মনোযোগ ছিলো বেশি। তিনি অসংখ্য মন্দির, ভাস্কর্য, ওবেলিস্ক (লম্বা দৈত্যাকৃতির মূর্তি) নির্মাণ করেন।
তার সময়ে তৈরি স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো কর্নাক মন্দির। মিশরের লাক্সারে নীলনদের তীরে অবস্থিত এই মন্দিরে সুউচ্চ ওবেলিস্ক রয়েছে, সেই সময়ে পুরো মিশরের সবচেয়ে উচু ওবেলিস্ক ছিল এগুলোই।
হাতশেপসুতের তৈরি আরেকটি স্থাপনা হলো মা’আত মন্দির। কর্নাক কমপ্লেক্সের এই মন্দিরের দেয়ালে দেয়ালে অত্যন্ত চমৎকারভাবে খোদাই করা আছে হাতশেপসুত আর তৃতীয় থুতমোসের মূর্তি। আয়তাকার কমপ্লেক্সের ঠিক মাঝখানটাতে আছে সুবিশাল এক হল। তখনকার বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক কাজে ব্যবহৃত হত এটি।
এই রানির সাফল্য যে শুধু স্থাপত্যশৈলীতেই সীমাবদ্ধ ছিল তা কিন্তু নয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও তিনি সমানভাবে সফল হয়েছিলেন। তিনি ২০০ বছর আগে ভেঙে যাওয়া বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে অষ্টাদশ রাজবংশের সম্পদ গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি করেন। তার এই সফলতা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহাল ছিল।
হাতশেপসুতের মৃত্যু হয় তার সিংহাসনে আরোহণের প্রায় দুই যুগ পর। উনিশ শতকে বিখ্যাত ইজিপ্টোলজি এবং হায়ারোগ্লিফিক কোডার জন ফ্রান্সিস শ্যাম্পলিয়ন হাতশেপসুতের নাম পুনরায় ইতিহাসের পাতায় ফিরিয়ে আনেন। নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামে তার জন্য আলাদা একটি কক্ষই আছে। যেখানে তুলে ধরা হয়েছে তার জীবনকালের নিদর্শনসমূহ।
বাংলা৭১নিউজ/এসএন