চলনবিলের তীরে ভেঙে পড়ছে বড় বড় ঢেউ। দিগন্ত জুড়ে জলরাশির খেলা। অথই পানিতে উন্মুক্ত মাছ, ডিঙি, পালতোলা ও ইঞ্জিনচালিত শ্যালো নৌকার বাহারি সব সাজ। চলছে বিনোদন ভ্রমণের নিত্য আয়োজন। আর শুকনো মৌসুমে প্রান্তর জুড়ে নানা রকম শস্যে সজ্জিত সবুজের সমারোহ। বিচিত্র প্রকৃতির অপার শোভায় মনপ্রাণ কেড়ে নেয় বিল এলাকা।
দেখা যায়, বিস্তৃত জলরাশির বুকে ঢেউ ভাঙার খেলা। মাঝেমধ্যে দিগন্ত রেখায় সবুজের আলপনা। এরমধ্যে ঢেউ ভেঙে ছুটে চলেছে যান্ত্রিক শ্যালো নৌকা। আছে মাছধরার বিচিত্র আয়োজনও। এটাই বর্ষা মৌসুমের চলনবিল। জীববৈচিত্র্যের বিপুল সমাহার। নাটোর-সিরাজগঞ্জ-পাবনা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এ বিলের অবস্থান। শুকনো মৌসুমে বিলের আয়তন অনেক কমে গেলেও তা প্রাণ ফিরে পায় বর্ষাকালে। তাই ভ্রমণ পিপাসুদের বর্ষা মৌসুমে চলনবিল হয়ে উঠেছে উপযুক্ত গন্তব্য।
দ্বীপের মতো গ্রামগুলো যেন একেকটা ভাসমান বাজার। বর্ষায় এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক পাড়া থেকে অন্য পাড়া, গ্রাম থেকে শহর, স্কুল-কলেজসহ যোগাযোগের সব জায়গায় ভাসমান মানুষগুলোর নিত্য সঙ্গীই যেন ঐতিহ্যবাহী ডিঙি নৌকা। কোনোটা চলছে পাল উড়িয়ে, কোনোটা ঠেলা নৌকা, আবার কোনোটা স্টিলের তৈরি ইঞ্জিনচালিত।
চলনবিলের চাটমোহরের বওশা, বোয়ালমারী, গুরুদাসপুরের বিলশাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে প্রকৃতি পিয়াসি দর্শনার্থীদের এখন উপচে পড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে। নানা শ্রেণিপেশার মানুষ এখানে এসে ভিড় করছে বিশুদ্ধ বিনোদনের জন্য। চাটমোহরের বোয়ালমারীর চলবিলীয়ার জলনিসর্গ পাথার, চাটমোহর-মান্নাননগর মিনি মহাসড়কের বিল আর নদীর মিলনের জলকেলি, হান্ডিয়ালের বুড়োপীরের আস্তানা, জগেশঠের বাংলো, জগন্নাথ মন্দির হাতছানি দেয় এ বর্ষায়। নাটোরের গুরুদাসপুরে ‘চলনবিল জাদুঘরে’ গিয়ে দেখা যাবে বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর প্রতিচ্ছবি।
এখনো দেখা যায় গহনার নৌকা, তালের ডোঙ্গা, কলাগাছের ভেলা, পানসি নৌকা, গরু ও মহিষের গাড়ি, পালকি ও ডুলি, ঘোড়া, সেঁউতি, জাঁতা, বাথান, খরম, হুকা, পাতকুয়া, তফিল ও গাইজা, বাদ্যযন্ত্র, কলের গান, পলো বিভিন্ন দেশের টাকা মুদ্রা, তির-ধনুকসহ বাহারি সব প্রাচীন তৈজসপত্র। এছাড়া চলনবিলের বুকচিরে নির্মিত হয়েছে মা জননী সেতু। পাশেই রয়েছে দুটি বিনোদনকেন্দ্র। চলনবিলের সৌন্দর্যকে আরো আকর্ষণীয় করেছে বালিহাঁস, তিরমূল, বাটুলে, মুরগি, হাঁস, খয়রা, মানিক জোড়, ডুটরা, চাপাখি, লোহাড়াং, মেমারচ, বোতক, নলকাক, সাদা বক, কানাবক, ফেফী, ডাহুক, চখা, বকধেনু, ইচাবক, করা, কাছিচোরা, রাতচোরা, ভুবনচিলা, মাছরাঙা, পানকৌড়িসহ নানা প্রজাতির পাখপাখালি।
চলনবিল পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বেড়া, নাটোর জেলার সিংড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, নওগাঁ জেলার রানীনগর, আত্রাই, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া ও বগুড়া জেলার দক্ষিণাঞ্চল মিলে চলনবিলের অবস্থান। মোট আটটি উপজেলার ৬২টি ইউনিয়ন এবং আটটি পৌরসভা নিয়ে বর্তমানে চলনবিল গঠিত। যার গ্রাম সংখ্যা ১ হাজার ৬০০টি, লোকসংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষাধিক। চলনবিল অঞ্চলে রয়েছে ২১টি নদী ও ৯৩টি ছোটবড় বিল।
চাটমোহরের নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সৈকত ইসলাম বলেন, চলনবিল পর্যটন এলাকা হতে পারে। সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিলে এর জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ, প্রকৃতি রক্ষা হবে। ইতিমধ্যে এলজিইডির মাধ্যমে চলনবিল রক্ষায় একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
বাংলা৭১নিউজ/এমকে