মানিকগঞ্জের কালীগঙ্গা নদী দখল করে মাছের ঘের তৈরি করে বছরে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করছে একটি প্রভাবশালী মহল। এতে নদীর সৌন্দর্য হারানোর পাশাপাশি হারাচ্ছে স্রোত ও নাব্য। এসব অবৈধ ঘেরে বালি আটকে দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীটি।
জানা যায়, মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের যমুনা থেকে কালীগঙ্গা নদীর উৎপত্তি। ঘিওরের জাবরা হাটের কোল ঘেঁষে মানিকগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে বেউথা হয়ে সিংগাইরের ধল্লা পর্যন্ত এ নদীর বিস্তৃতি। এর মধ্যে বেউথা থেকে বরুন্ডি পর্যন্ত প্রায় ২৫০টি পয়েন্টে নদী দখল করে মাছের ঘের তৈরি করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঘের তৈরি করা হয়েছে সদর উপজেলার লেমুবাড়ি, বালিরটেক ও বরুন্ডি এলাকায়। প্রতিটি ঘের থেকে প্রতি বছর দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকার করে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কালিগঙ্গা নদীর লেমুবাড়ি বালিরটেক ও বরুন্ডি এলাকায় প্রায় দুই শতাধিক মাছের ঘের তৈরি করা হয়েছে। আর বেউথা থেকে লেমুবাড়ি পর্যন্ত প্রায় ৫০টি ঘের তৈরি করা হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বালিরটেক ও বরুন্ডি এলাকায়। এসব অবৈধ ঘের তৈরি করেছেন ভারারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেনসহ এলাকার প্রভাবশালী মহল।
বরুন্ডি, বালিরটেক ও শানবান্দা এলাকার একাধিক ব্যক্তি ও জেলে সম্প্রদায়ের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বালিরটেক ও বরুন্ডি এলাকার একটি মহল এই ঘেরের মালিক। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী হলেন ভারারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন, মাছের আড়তের ব্যবসায়ী মইজুদ্দিন, রফিক, পরান, আনন্দ, গরংগো, বারেক, অনিল, যইটা মাঝি, বিশা, হকেন মাহাকি, আমজাদ মাহাকি, নাজির ও কামাল।
বালিরটেক ঘাটের মাঝি জমসেদ আলী বলেন, এই নদীর বেশিরভাগ ঘেরের মালিক চেয়ারম্যান ও তার কাছের লোকজন। বর্ষাকালে নদীতে ঝাঁটা মারে আর চৈত্র মাসে মাছ ধরে। শুনেছি অনেক টাকার মাছ বিক্রি করে। এই নদীতে নৌকা বাই প্রায় ৩০ বছর। দশ বছর ধরে এভাবে ঝাঁটা ফেলে মাছ ধরে তারা। এর আগে এভাবে মাছ ধরতে দেখিনি। আগে জেলেরা এই নদী থেকে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করতো।
ঘেরের মালিক শানবান্দা এলাকার বাসিন্দা নিরঞ্জন বলেন, আমি বিদেশে থেকে এসে এই ব্যবসা শুরু করেছি। নদীতে আমার দুইটি ঘের আছে। একটা শানবান্দা, আরেকটি বালিরটেক বাজার ব্রিজের পাশে। ব্রিজের পাশেরটা আমি ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি। বছরের মধ্য সময়ে মাছ ধরি। খরচ বাদ দিয়ে প্রতিটি ঘের থেকে ১ থেকে ২ লাখ টাকা লাভ হবে। চার বছর ধরে এই ব্যবসা করছি।
শানবান্দা মাছের আড়তের ব্যবসায়ী মইজুদ্দিন বলেন, আমি ছোট ব্যবসায়ী। আমার নদীতে ঘের আছে কয়েকটা। বছর শেষে ওই ঘের থেকে কিছু টাকা পাই। বুঝতেই পারছেন সবাইকে দিয়ে কিছু থাকে না। প্রতিটি ঘের থেকে কোনো কোনো বছর ভাগে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পাই। আবার কোনো কোনো বছর লস হয়।
ভারারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন বলেন, নদীতে আমার কোনো মাছের ঘের নেই। আমি একজনের সঙ্গে মাছের ব্যবসা করি, সে হয়ত আমার নামে ঘের তৈরি করতে পারে। তাছাড়া এই ঘেরের কারণে নদীর কোনো ক্ষতি হয় না। জেলেরা ঘের তৈরি করে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে।
নদীরক্ষা আন্দোলন মানিকগঞ্জ জেলা শাখার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস বলেন, নদী রাষ্ট্রীয় সম্পদ। কেউ যদি ব্যক্তিস্বার্থে নদীতে বাঁধ সৃষ্টি করে বা নদীর পানির প্রবাহকে বাধা দেয়, সেটি অপরাধ। আমি আশা করি প্রশাসন এই বিষয়ে নজর দেবে।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। আপনার মাধ্যমে ঘের তৈরি করে মাছ শিকারের বিষয়টি জানতে পারলাম। এটা একটা অপরাধ। খোঁজ নিয়ে দেখি, যদি এমনটা হয়ে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান বলেন, নদীতে ঝাঁটা বা কোনো কিছু ফেললে নদীর পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়। সেক্ষেত্রে নদীর তলদেশে বালিকণা জমে আস্তে আস্তে নদীটি ভরাট হয়ে যায়। মাছের ঘের তৈরি করে যদি কেউ পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড করবে।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মেজবাহ উল সাবেরিন বলেন, ইউনিয়ন ভূমি অফিসের নায়েবদের পাঠিয়ে খোঁজ নেবো। যদি কেউ অবৈধভাবে ঘের তৈরি করে মাছ শিকার করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ