সাধারণ অর্থে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। শিক্ষা কোনো ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলির পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেয় এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যেসব দক্ষতা প্রয়োজন, সেগুলো অর্জনে সহায়তা করে। আর কারিকুলাম হলো শিক্ষার একটি বিশেষ স্তরের শিক্ষণীয় বিষয়ের সমষ্টি বা পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু, শিক্ষাদানের পদ্ধতি, মূল্যায়নের কৌশল, বিভিন্ন উপকরণ ও শিক্ষাসংক্রান্ত বিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মসূচি—এই সবকিছুই কারিকুলামের অন্তভুর্ক্ত। তাই শিক্ষার ক্ষেত্রে কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রমের গুরুত্ব অপরিসীম।
বাংলাদেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় নতুন কারিকুলাম প্রণয়নের জন্য ২০১৬ সালে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। গঠিত কমিটি বেশ কিছু সুপারিশ প্রস্তাব করে। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য কয়েকটি সাবকমিটি গঠন করা হয়। শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা সাবকমিটি ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর শিক্ষা কারিকুলাম-সংক্রান্ত ৮ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করে।
পরে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর জাতীয় সংসদে বলেন, ‘আমাদের কারিকুলাম পুরো পর্যালোচনা হচ্ছে। শিগ্গিরই চূড়ান্ত করা হবে।’ ২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী পরিমার্জিত কারিকুলামের প্রস্তাবিত খসড়া অনুমোদন করেন। এরপর শিক্ষামন্ত্রী পরিমার্জিত কারিকুলামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘শিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলা এবং শ্রেণিকক্ষেই পাঠদান সম্পূর্ণ করার ব্যবস্হা রেখে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, পুরো শিক্ষাক্রম হবে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক, ‘পড়াশোনা হবে আনন্দময়। বিষয়বস্তু ও পাঠ্যপুস্তকের বোঝা এবং চাপ কমানো হবে। মুখস্হ নির্ভরতার বিষয়টি যেন না থাকে, এর বদলে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শেখাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলা ও অন্যান্য কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষেই অধিকাংশ পাঠ সম্পূর্ণ করবে, এরপর তারা নিজেদের মতো সময় কাটাতে পারবে। পড়াশোনার বাইরে খেলাধুলা ও অন্যান্য বিষয়ের সুযোগ কমে গেছে, এটা যেন আর না হয়। জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে শিক্ষার্থীদের।’
নতুন শিক্ষা কারিকুলামে সন্নিবেশিত মূল বিষয়বস্তুগুলো হলো :প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে কোনো ধরনের পরীক্ষা থাকবে না। চতুর্থ থেকে অষ্টম পর্যন্ত সব শ্রেণিতে স্কুলের শ্রেণি সমাপনী পরীক্ষা হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে পিইসি, জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা থাকবে না। নবম ও দশম শ্রেণির বই আলাদা হয়ে যাবে। নবম শ্রেণির শেষে স্কুলেই সমাপনী পরীক্ষা হবে। শুধু দশম শ্রেণিতে যা পড়ানো হবে, তার ওপরে ভিত্তি করে এসএসসি ও সমমানের পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
নতুন কারিকুলামে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগে বিভাজন করা হবে না। একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরে সব বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হবে এবং জ্ঞান লাভ করবে। অর্থাত্, সব ধরনের শিক্ষা বা অভিন্ন শিক্ষা নিয়েই শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করতে হবে। উচ্চমাধ্যমিকের ক্ষেত্রে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আলাদা বই থাকবে, প্রতিটি শ্রেণির পাঠ শেষে আলাদাভাবে পরীক্ষা হবে।
প্রাথমিকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে শিখনকালীন বা ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে শতভাগ। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন, অর্থাত্ পরীক্ষা হবে ৪০ শতাংশ।
শারীরিক ও মানসিক স্বাস্হ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্পকলা (বিদ্যমান চারু ও কারুকলা)—এগুলো শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে। মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ আর বছর শেষে পরীক্ষা হবে ৪০ শতাংশ।
অন্যান্য বিষয় জীবন ও জীবিকা, তথ্যপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্হ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ। নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৫০ শতাংশ আর বছর শেষে পরীক্ষা হবে ৫০ শতাংশ, অর্থাত্ দশম শ্রেণির শেষে ৫০ শতাংশ নম্বরের এসএসসির পাবলিক পরীক্ষা হবে। অন্যান্য বিষয়ের শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ।
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আবশ্যিক বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন ৩০ শতাংশ এবং পরীক্ষা হবে ৭০ শতাংশ, অর্থাত্ পাবলিক পরীক্ষা দিতে হবে ৭০ শতাংশ। নৈর্বাচনিক/বিশেষায়িত বিষয়ে কাঠামো ও ধারণায়ন অনুযায়ী সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক, ব্যাবহারিক ও অন্যান্য উপায়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে। প্রায়োগিক বা ঐচ্ছিক বিষয়ের শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর প্রতি বর্ষ শেষে একটি করে পরীক্ষা হবে। এ দুই শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধরিত হবে।
দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণ প্রস্তাবিত কারিকুলামকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। এ ধরনের সুপারিশ কুদরত-ই-খুদা কমিশনের প্রস্তাবেও ছিল। গত ১৯ ফেব্র‚য়ারি ২০২২ শিক্ষামন্ত্রী নতুন কারিকুলামের পাইলটিংয়ের জন্য প্রণয়নকৃত পাঠ্যপুস্তক বিতরণ উদ্বোধন করেছেন। এ বছর ৬২টি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামের পাইলটিং বা পরীক্ষামূলকভাবে পাঠদান কার্যক্রম চলবে, প্রাথমিকেও পাইলটিং শুরু হচ্ছে এ মাসেই, অর্থাত্ মার্চেই।
এই কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন হলে আগামী বছর প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা হবে। ২০২৪ সালে তৃতীয় ও চতুর্থ এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে, ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে প্রবর্তন করা হবে। ২০২৬ ও ২০২৭ সালে উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে চালু করা হবে।
নতুন কারিকুলাম সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়নের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন যথাযথভাবে প্রণীত পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক। পরীক্ষামূলকভাবে পাঠদান কার্যক্রম ও শিক্ষক প্রশিক্ষণকালীন উঠে আসা সমালোচনা ও সুপারিশসমূহ আমলে নিয়ে অন্তভুর্ক্তকরণের ব্যবস্হা করা প্রয়োজন। বাস্তবায়নের আগেই শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্হা করতে হবে।
শিখনকালীন মূল্যায়নের ব্যাপারে শিক্ষকদের নিবিড় প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কারণ, এ ব্যাপারে শিক্ষকদের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। বিশেষ করে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়নের বিষয়গুলো যে উদ্দেশ্যে অন্তভুর্ক্ত করা হয়েছে, তার প্রতিফলনের জন্য শিক্ষকদের পেশাদারি মনোভাব, নিষ্ঠা ও সর্বোচ্চ নীতি-নৈতিকতা অত্যাবশ্যক।
প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের মোটিভেশন বা উদ্বুদ্ধকরণের ব্যবস্হা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সীমিত আকারে হলেও শিক্ষকদের সম্মানির ব্যবস্হা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে শিক্ষকদের জন্য উৎকৃষ্ট মানের ও সবিস্তারিত ‘প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল’ বা শিক্ষক সহায়িকা সরবরাহ করতে হবে।
যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খোলা মাঠ নেই, অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তাদের খেলার মাঠের ব্যবস্হা করা প্রয়োজন। দীর্ঘদিন যাবত্ এসএসসিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ চালু আছে। এখন বিভাগ বিভাজন না করে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ সমাপনের জন্য বিভাগগুলোর বিষয়সমূহের মৌলিক ধারণার জন্য অত্যাবশ্যকীয় কনটেন্টগুলো বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তকে সন্নিবেশ করাতে হবে।
এর সঙ্গে সমন্বয় করে উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যসূচি নির্ধারণ করতে হবে, যাতে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের ঘাটতি না থাকে। আবার এসএসসি পাশ করার পর কিছু শিক্ষার্থী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, মেডিক্যাল টেকনোলজিসহ বিভিন্ন কারিগরি ও ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়। তাদের জন্যও এসএসসির পাঠ্যসূচিতে বিষয়ভিত্তিক মৌলিক কনটেন্টগুলোর কথা মাথায় রাখতে হবে।
করোনাকালে অনলাইন ক্লাস পরীক্ষার সুবাদে শিশু-কিশোরদের মোবাইল আসক্তি অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির পাঠ্যপুস্তক রচনার সময় তথ্যপ্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহার রোধকল্পে নিবন্ধ অন্তভুর্ক্ত করা যেতে পারে।
উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং জ্ঞানভিত্তিক ও নৈতিকতা বোধসম্পন্ন জাতি গঠনে যথোপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্হা অপরিহার্য। আমরা আশাবাদী হতে চাই, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের নতুন কারিকুলাম এই লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
লেখক: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সন্তোষ, টাঙ্গাইল
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ