খুন ফারসি শব্দ। রক্ত এবং হত্যা- এই দুই অর্থেই খুন শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু এখন বাংলা শব্দে যেভাবে হত্যাকাণ্ড বোঝাতে খুন শব্দটি ব্যবহার হয়, সেটি মূলত এসেছে কবিতা এবং সংবাদপত্রের ব্যবহার থেকে।
কথিত আছে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার অগ্নিবীণা কাব্যগন্থে প্রথম হত্যা বোঝাতে খুন শব্দ ব্যবহার করেছিলেন।
কিন্তু ভাষাতত্ত্ববিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।
তিনি বলছেন, ‘আমার মনে হয় না নজরুলই প্রথম ব্যবহার করেছেন এই শব্দ। তবে এটা ঠিক যে রক্ত বোঝাতে কাজী নজরুল ইসলাম খুন শব্দটি ব্যবহারের পর বিষয়টি নিয়ে সে সময় অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল।’
’‘কাজী নজরুল ইসলাম শব্দটি ব্যবহারের পর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন ‘খুন শব্দটি শুনলেই কেমন বীভৎস মনে হয়, আর নজরুল সেটা ব্যবহার করলেন’। বিষয়টির তিনি সমালোচনা করেছিলেন বলেও জানা যায়,’’ অধ্যাপক রহমান বলেন।
সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের পর তার সমসাময়িক অনেকেই এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
কেবল সাহিত্য বা সংবাদপত্র নয়, আইনের পরিভাষায়ও ‘খুন’ শব্দটি অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।
সেখানে ‘খুন’ বলতে একজন মানুষকে বিচার বহির্ভূতভাবে বা কোনো অজুহাতে, বিশেষ করে কারো সাথে আক্রোশ থেকে বেআইনিভাবে তাকে হত্যা করাকে বোঝায়।
আর হত্যাকাণ্ডে বা কাউকে বলপূর্বক মেরে ফেললে বেশিরভাগ সময় যেহেতু রক্তপাত হয়, সে কারণে পরবর্তীতে দেখা গেল সংবাদপত্রে খুন শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়ে যায়।
বাংলা ভাষায় আকুল হওয়া এবং ক্রোধ অর্থেও খুন শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যেমন ‘ভেবে ভেবে খুন হলাম’ কিংবা ‘মাথায় খুন চেপেছে’ এমন শব্দমালার ব্যবহার অভূতপূর্ব নয়।
ব্যাকরণগত দিক থেকে বলা যায়, রক্তের আসল অর্থ মানে যে ধাতু থেকে সেটা এসেছে সংস্কৃত শব্দ রন্জ্ থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুনিরা সুলতানা বলেছেন, সংস্কৃত রঞ্জ শব্দ বিশ্লেষণ করলে এর ধাতু বা ক্রিয়ামূলকে আলাদা করে লেখার সময় সেটাকে রন্জ্ লেখা হয়।
রন্জ্ ধাতু দিয়ে সাধারণত রঙিন বস্তু বোঝানো হয়। কিন্তু যেকোনো রঙিনকে ‘রন্জ্’ বলা হত না, নির্দিষ্ট একটি লাল রঙয়ের একটি বিশেষ পদার্থকে বোঝানোর জন্য এই শব্দ ব্যবহার করা হত।
‘এটাই অর্থের সংকোচন হয়ে ভাষাগতভাবে রক্ত হয়েছে,’ বলেছেন ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রহমান।
আবার রঞ্জক শব্দটি দিয়ে কোনো কিছু রাঙানোকে বোঝানো হয়।
তবে বাংলা সাহিত্যে খুন শব্দটি আরো নানাভাবে ব্যবহার হয়েছে।
আক্ষরিক হত্যাকাণ্ড বোঝানোর জন্যই কেবল নয়, ‘হেসে খুন হওয়া’ ‘কেঁদে খুন হওয়া’ এমন শব্দবন্ধও প্রচলিত আছে বাংলা ভাষায়।
কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বিখ্যাত কবিতার পঙক্তি ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে…আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ বহুল ব্যবহৃত।
প্রবল সাহস আর উদ্দীপনা যোগাতে এই পঙক্তিমালা আবৃত্তি এবং গান হিসেবে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ব্যবহার করা হয়েছে।
তবে ‘খুন’ শব্দটি সাধারণত মানুষের বেলায় ব্যবহৃত হয়, পশুপাখির ক্ষেত্রে ‘খুন’ ব্যবহার হবে না, সেখানে ব্যবহার করা হবে ‘হত্যা’।
সূত্র : বিবিসি
বাংলা৭১নিউজ/এবি