রাজধানী ঢাকা আজ বসবাসের জন্য অযোগ্য এক শহরে পরিণত হয়েছে। যানজট, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণের কারণে রাজধানীবাসীর জীবন ওষ্ঠাগত। ইতিপূর্বে বায়ুদূষণে একাধিকবার বিশ্বের শীর্ষস্থান দখল করেছে ঢাকা।
গতকাল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেখা গেছে, ঢাকা শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষে! শব্দদূষণের দিক থেকে ঢাকার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুদারাবাদ ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ। শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি শহরের তিনটিই দখল করেছে দক্ষিণ এশিয়া। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ এবং সেই সঙ্গে যানজটে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী। যানজটে মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।
বিগত দুটি বছর করোনার কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় এবং স্বাস্হ্যঝুঁকি ও লকডাউনের কারণে মানুষ ঘর থেকে তেমনভাবে বের হতে না পারায় যানজট, শব্দদূষণ তথা বায়ুদূষণের তীব্রতা নগরবাসী প্রায় ভুলতে বসেছিল। বর্তমানে করোনার প্রভাব কমে যাওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, অফিস-আদালত পুরোদমে শুরু হওয়ায় এই যন্ত্রণা আবারও শুরু হয়েছে।
যানজটে ঢাকা শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে এমন কোনো রাস্তা নেই, যেখানে যানজটে স্থবির হয়ে যাচ্ছে না জীবনের গতি। এতে প্রতিদিন শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে ঢাকাবাসী। রাজধানীর যানজট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ঘর থেকে বের হতেই শুরু হয় যানজট।
যানজটের কারণে জিডিপির ক্ষতি হচ্ছে আড়াই শতাংশ। শুধু জিডিপির ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, এর সঙ্গে কত সময়, কর্মঘণ্টা, শারীরিক ও মানসিক চাপ, অর্থাৎ স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে, সেই হিসাব করলে এই ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে যাবে, যা টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা কঠিন।
বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ ও যানজটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি, ধুলাবালু দূষণ ও মশা-মাছির সীমাহীন অত্যাচার। সিটি করপোরেশনগুলো এ বিষয়ে নির্বিকার বলা চলে। কালেভদ্রে যদিও মশার অষুধ ছিটানো হয়, তা বাস্তবে কোনো কাজেই আসে না। লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেখে চড়া দামে মশার কয়েল কিনলেও নকল কয়েলের ধোঁয়ায় মশার কিছুই যায় আসে না।
আমাদের জীবনটাই ভেজালে ভেজালে সয়লাব হয়ে গেছে। মশার কয়েল থেকে শুরু করে এমন কোনো খাদ্যদ্রব্য বা সেবা নেই, যাতে ভেজাল দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের জীবনে শান্তি কোথায়? ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত অশান্তিতে জ্বলছি নিম্ন আর মধ্যম আয়ের মানুষগুলো।
ঘরে পছন্দমতো খাদ্যসামগ্রীসহ জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণের চাহিদা মেটাতে না পারায় পরিবারে অশান্তি লেগেই আছে। তার ওপর তীব্র গরমে রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকায় ধুলোবালু, শব্দদূষণ আর বায়ুদূষণে নাকাল হয়ে যাচ্ছে মানুষ। এক কথায়, ঘরে-বাইরে মানসিক প্রশান্তির অভাবে পিষ্ট হচ্ছে রাজধানীবাসী।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রমজান। রাস্তা দিয়ে হাঁটাচলা করারও কোনো সুযোগ নেই। ফুটপাত দখল করে আছে হাজার হাজার হকার। ঈদ সামনে রেখে হকারেরা যত্রতত্র ফুটপাত দখল করে তাদের পণ্য নিয়ে বসে পড়েছে। আসছে ঈদ। এখন থেকেই শুরু হয়েছে কেনাকাটার ধুম। কিন্তু কারো শহর বা দেশ বিষয়ে সচেতনতা চোখে পড়ে না। আমরা পত্রপত্রিকায় দেখেছি, কত হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
তাইতো ঢাকা শহরের রাস্তায় প্রতিদিন নতুন নতুন মডেলের গাড়ি বাড়ছেই। এত বিলাসিতা যেখানে, সে দেশের পরিচ্ছন্নতার বিলাসিতা নেই কেন? একদিকে নিরন্ন মানুষ, অন্যদিকে নতুন নতুন মডেলের গাড়ি। ঘরে-বাইরে নেই কোথাও স্বস্তি। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে চিরে চ্যাপ্টা, দিশেহারা জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যানজট, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, গ্যাসের সংকট। সড়কে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না। সব মিলে জনজীবন একেবারেই ওষ্ঠাগত।
এবারে প্রথম রোজার দিন থেকেই বেশ কিছু এলাকায় শুরু হয়েছে গ্যাসের সংকট। এই সংকটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পুনরায় বাড়ানো হয়েছে এলপিজির দাম। জানা যায়, বিগত চার মাসে প্রায় চারবার এই গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো। এমন দুর্বিষহ জীবন নিয়ে রোজাদারদের শারীরিক ও মানসিক কষ্ট দেখার কেউ আছে বলে মনে হয় না।
তীব্র গরমে, অসহনীয় যানজটে মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। বিশেষ করে রোজাদারদের দুর্গতি আরো চরমে। জানা যায়, শুধু রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মাসে গড়ে ১৫ থেকে ১৭ জন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। সড়ক পরিবহন কতৃর্পক্ষের (বিআরটিএ) ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী লাইসেন্সবিহীন চালক রয়েছেন সাড়ে ৭ লাখ।
(এ বছরের জানুয়ারিতে পত্রিকান্তরে পাওয়া তথ্যানুযায়ী লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা ২৪ লাখ)। বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে ৮৬ শতাংশ। দেশে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ৪৪ লাখ ৯৪ হাজার ৪২০। এসব গাড়ির বিপরীতে লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ৩৭ লাখ ৬৩ হাজার ১৭৪। ৭ লাখ ৩১ হাজার ২৪৬টি গাড়ির বৈধ চালক নেই।
এ তথ্যের বাইরেও ছোট-বড় অনেক গাড়ি রাজপথে চলছে, যার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এসব অদক্ষ চালকের কারণে রাস্তায় যানজট ও দুর্ঘটনা লেগেই আছে। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা এই ভয়াবহ সমস্যার আজও কোনো সমাধান হয়নি। মৃত্যুর মিছিল না কমে বলা যায় আরো বেড়েছে। কারণ লাইসেন্সবিহীন, লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়িতে ভরপুর রাজপথ।
লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছেন। দুর্নীতিবাজ ট্রাফিক পুলিশ এসব দেখেও না দেখার ভান করছে। তাদের চোখের সামনে দুর্ঘটনা ঘটছে, কিন্তু তারা কতটা দায়িত্ব পালন করছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে এ যাবত্ বহু আন্দোলন, লেখালেখি, মিছিল, মিটিং, অবরোধসহ এমন কিছু নেই, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি এবং হচ্ছে না।
শুধু যানজট নয়, মনুষ্যজটেও রাস্তায় চলাচল করা কঠিন। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে আসছে এই শহরে। স্রোতের মতো মানুষ বাড়ছে। অফিস-আদালত, ব্যাংক-বিমা, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিসহ সবকিছুই ঢাকামুখী হওয়ায় এ শহর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরে রূপ নিয়েছে। বড় বড় অফিস-আদালত, ব্যাংক-বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ কিছু কিছু দপ্তর বিকেন্দ্রীকরণ করার কথা বলা হলেও তেমনভাবে তা করা হচ্ছে না। সবকিছুই ঢাকামুখী হওয়ায় এই শহরের আজ এই করুণ দশা। বায়ুদূষণের অন্যতম আর একটি কারণ হলো বর্জ্য নিষ্কাশন।
এই শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। রাজপথে যেখানে-সেখানে বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখা যায়। অলিগলির কথা তো বাদই দিলাম। দিনদুপুরে রাজপথে ময়লা-আবর্জনা ছিটাতে ছিটাতে ময়লার গাড়ি নির্বিকারভাবে ময়লা বহন করে চলছে। দুর্গন্ধে পথ চলা দায়।
জনগণ কর দিচ্ছে, কিন্তু প্রকৃত সেবা পাচ্ছে না। সেবার মানোন্নয়নে সরকারকে বিশেষভাবে নজর দেয়া দরকার। পত্রিকার পাতা খুললেই ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণের খবর। এটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানা যায়, গত ছয় মাসে রাজধানীতে ২০-এর বেশি মানুষ খুন হয়েছে। দূষিত পানি পান করে ডায়রিয়া রোগীদের ভিড়ে হাসপাতালের অবস্থা করুণ।
রোগী রাখার জায়গা নেই ডায়রিয়া ও কলেরা হাসপাতালে। শিশুরা অপেক্ষাকৃত বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিত্সা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) ২০২০ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অভিভাবকেরা যত শিশু হাসপাতালে নিয়ে যান, তার ৪৯ শতাংশ শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার বাতাসে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর পারদ, সিসা, ক্যাডমিয়াম, নিকেলসহ বিভিন্ন ধরনের ভারী বস্তকণা ভাসছে। এর ফলে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার।
বিশ্বব্যংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ সালে দেশে গড়ে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ১ কেজি। ঢাকায় ৯ দশমিক ২ কেজি। ২০২০ সালে তা বেড়ে দেশে গড়ে ৯ কেজি এবং ঢাকায় তা ২৪ কেজিতে পৌঁছেছে। সব মিলে এবারের রমজানটা দেশের তথা ঢাকাবাসী স্বস্তির মধ্য দিয়ে কাটাতে পারছে না। সংকট একটার পর একটা লেগেই আছে।
এর থেকে শিগ্গিরই কোনো নিষ্কৃতির পথ আছে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু এই অবস্থা তো দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে না। প্রচণ্ড যানজটের কবল থেকে রক্ষা করার পথগুলো সবার জানা আছে, তাই নতুন করে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ যত দ্রুত খুঁজে বের করা হবে, তত তাড়াতাড়ি ঢাকাবাসী এই বিপন্ন ও নিরাপত্তাহীন জীবন থেকে মুক্তি পাবে।
লেখক: অর্থনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক, সাবেক মহাব্যবস্হাপক, বিসিক
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ