দেশের সমুদ্রভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ শুরু করেছে সরকার। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বহু কাঙ্ক্ষিত এই কার্যক্রম শুরু হলো। উত্পাদন অংশীদারিত্ব চুক্তির (পিএসসি) আওতায় ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ওএনজিসি বিদেশ লিমিটেডের নেতৃত্বে একটি কনসোর্টিয়াম গত সপ্তাহে বঙ্গোপসাগরের অগভীর অংশে এই অনুসন্ধান-খনন শুরু হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে দেশীয় সরকারি কোম্পানি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) ও ভারতের অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড। বঙ্গোপসাগরের একটি অগভীর ব্লকে (এসএস-৪) তারা খনন সম্পন্ন করবে। এর মাধ্যমে প্রায় তিন দশক পর সমুদ্রের অগভীর অংশে গ্যাস অনুসন্ধান শুরু হলো। তবে গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান এখনো শুরু হয়নি।
সমুদ্রে গ্যাস সন্ধান কার্যক্রম শুরু করার দাবি শিল্প ও জ্বালানি খাতে দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চারিত হচ্ছে। বিদ্যমান গ্যাসের সংকট এবং গ্যাসের স্থানীয় ও বৈশ্বিক মূল্য বৃদ্ধির মধ্যে সেই দাবি আরও জোরালো হয়। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর এই খাতে অগ্রগতি না হওয়ায় অনেকেই হতাশ ও বিস্মিত। এবারের অনুসন্ধানে নতুন কোনো গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গেলে তা নিঃসন্দেহে সুখবর বয়ে আনবে। এখন পর্যন্ত দেশের সমুদ্রভাগে আবিষ্কৃত একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গু। ১৯৯৬ সালে ১৬ নম্বর ব্লকে আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রটি ২০১৩ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। গ্যাস ও খনিজ প্রাপ্তির সম্ভাবনা বিবেচনায় দেশের স্থলভাগকে ২২টি ও সমুদ্র ভাগকে ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এই ২৬টির মধ্যে ১১টি ব্লক অগভীর সমুদ্রে অবস্থিত। বাকি ১৫টি গভীর সমুদ্রে। এখন পর্যন্ত সমুদ্র ভাগের তিনটি ব্লক তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য মনোনীত করা হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিসুর রহমান জানান, করোনার সংক্রমণ শুরু না হলে অন্তত আরও এক বছর আগে এই খনন কার্যক্রম শুরু করা যেত। দেরিতে হলেও অনুসন্ধান শুরু করা গেল। এখানে গ্যাস পাওয়া গেলে শিল্প, আবাসিকসহ সব শ্রেণির গ্রাহকদের জন্য তা হবে বড় সুসংবাদ। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে গ্যাস আনা বা আমদানির পরিমাণ কমবে। তাতে বিদেশি মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
পেট্রোবাংলার এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, এসএস-৪ ব্লকের নিচে ৪ হাজার মিটার ড্রিলিং (খনন অনুসন্ধান) করবে ওএনজিসি। আগামী বছরও এই ব্লকে আরেকবার ড্রিলিং করা হবে।
৪ ও ৯ নম্বর ব্লকে অনুসন্ধানের জন্য ওএনজিসি বিদেশ ও অয়েল ইন্ডিয়ার সঙ্গে দুটি পিএসসি চুক্তি করেছে পেট্রোবাংলা। এ দুই ব্লকে বাপেক্সেরও ১০ শতাংশ অংশীদারিত্ব নির্ধারণ করেছে জ্বালানি বিভাগ। অর্থাৎ, অনুসন্ধান কার্যক্রমের খরচের ১০ শতাংশ মেটাবে বাপেক্স। আবার গ্যাস পাওয়া গেলে তার ১০ শতাংশ মালিকও হবে এই সংস্থা। আবিষ্কৃত গ্যাস নির্ধারিত দামে সরকারের কাছে বিক্রি করবে এই তিন ঠিকাদারি কোম্পানি।
পিএসসি অনুযায়ী, ব্লকটিতে নিজেদের খরচে জরিপ ও ড্রিল করবে ঠিকাদারি কোম্পানিগুলো। পরে গ্যাস বিক্রি থেকে তাদের খরচের ৫৫ শতাংশ প্রতি বছর দেওয়া হবে। আবিষ্কৃত উত্পাদনযোগ্য গ্যাসের সর্বনিম্ন ৬০ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত মালিকানা থাকবে পেট্রোবাংলার। একই সঙ্গে উত্পাদনযোগ্য তেলের ৭০ থেকে ৯০ শতাংশের মালিক হবে পেট্রোবাংলা।
জানা যায়, ওএনজিসি কনসোর্টিয়াম ইতিমধ্যে সাড়ে ৫ হাজার লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক ভূকম্প জরিপ সম্পন্ন করেছে। এর আগে ২০১৭ সালের মার্চে গভীর সমুদ্রের ১২ নম্বর ব্লকে অনুসন্ধানের জন্য দক্ষিণ কোরীয় কোম্পানি পসকো দাইয়ুর সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। কিন্তু গ্যাসের দাম নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারাসহ কয়েকটি কারণে সেই চুক্তি পরে বাতিল হয়।
বাংলাদেশ তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) তথ্য অনুযায়ী, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪২০-৪৩০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ রয়েছে ৩০০-৩২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। অর্থাৎ, ঘাটতি ১০০-১৩০ কোটি ঘনফুটে পৌঁছেছে। দেশের ইতিহাসে সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণের ঘাটতি। স্থলভাগে আবিষ্কৃত ও উত্পাদনরত গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মজুত ও উত্পাদন কমে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে সমুদ্রে গ্যাস সন্ধানের বিকল্প নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ