বাংলাদেশে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে আটকের পর তার বিরুদ্ধে নথি চুরি বা সরকারি ফাইলের ছবি তোলার অভিযোগ এনে মামলা করে তাকে জেলে পাঠানো হয়েছে কিন্তু প্রশ্ন উঠছে যে জনস্বার্থে যে কোন কৌশলেই হোক সাংবাদিকরা তথ্য বের করতে না পারলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সুযোগ কতটা থাকবে।
রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে বেশ কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখার পর সোমবার রাতে থানায় হস্তান্তরের পর থানার সামনে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ করছিলেন গণমাধ্যম কর্মীরা।
মিজ ইসলাম অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে ঢাকায় সুপরিচিত এবং তার বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অভিযোগ করেছে যে তিনি মন্ত্রণালয়ের সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার কক্ষে থাকা নথি চুরি ও একটি ফাইলের ছবি তুলেছেন যাতে, তাদের ভাষায়, দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় তথ্য ছিলো।
তবে তার পরিবার স্পষ্ট করেই বলেছে সাম্প্রতিক কিছু দুর্নীতির রিপোর্টের কারণেই তাকে হেনস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা তাহলে কিভাবে জনস্বার্থে গোপন তথ্য বের করে তা প্রকাশ করবেন? তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বুধবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলছেন তথ্য চুরি না করেও সরকারের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে এবং সে পদ্ধতি অনুসরণ করে যে কোন তথ্য পাওয়া সম্ভব বলে তিনি দাবি করেন।
“একটি পদ্ধতি আছে। যে কোন তথ্য পেতে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হয়। মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া না গেলে তথ্য কমিশনে আবেদন করতে হয়। ২০১৪ সালে তথ্য কমিশন গঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এক লাখ উনিশ হাজার ৮৩১ টি আবেদনের নিষ্পত্তি হয়েছে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত। শুধু নন-ডিসক্লোজার আইটেম তিনি পাবেন না। তথ্য কমিশনের নির্দেশনার পর কেউ তথ্য না দিলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা দায়ী থাকবেন। অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াও হয়েছে, জরিমানা করা হয়েছে”।
কিন্তু বাস্তবতা হলো তথ্য অধিকার আইনে তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিদের নিয়ে দুর্নীতি, অনিয়ম, কিংবা অব্যবস্থাপনার বিষয়ে তথ্য পাওয়ার উদাহরণ নেই। সাধারণ তথ্য বা যেগুলো সরকারকে বিব্রত করবে না- সাধারণত এমন তথ্যই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো থেকে পাওয়া যায়। যেমন গত বছর স্বাস্থ্যখাতেরই একটি বিষয়ে তথ্য পেতে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক আসিফ জাহাঙ্গীর।
তিনি বলছেন, গত বছর মার্চে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের পর করোনা ব্যবস্থাপনার একটি বিষয়ে প্রতিবেদনের জন্য তথ্য পেতে তিনি স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন।
“যোগাযোগের পর কোন তথ্য দিতে রাজী না হয়ে তিনি আমাকে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করতে বলেন। সেটি করার পর তিনি তথ্য কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। তার কাছে গিয়ে চিঠি দেয়ার এর এক দু মাস পরও কোন উত্তর এলোনা।” “আবার ওই কর্মকর্তার কাছে গেলাম। এমন ৫/৭ বার দফায় দফায় যোগাযোগ করেছি। সর্বশেষ প্রায় ছয় মাস পর তারা জানিয়ে দেয় যে তারা কোন তথ্য দিতে পারবে না”।
তথ্য অধিকার আইনে অনিয়ম বা দুর্নীতি বিষয়ক কোন তথ্য চাইলে তা সরকারি দফতরগুলো দিয়েছে এমন কোন নজির তো নেই-ই বরং অনেক ক্ষেত্রে মাসের পর মাসে আবেদনের কোন জবাবও দেয়া হয় না। তাহলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে তথ্য তুলে নিয়ে এসে তা জনস্বার্থে প্রকাশের জন্য কোন পথ অবলম্বন করেন সাংবাদিকরা? মিস্টার জাহাঙ্গীর বলছেন আবেদন করে তথ্য না পেয়ে, পরে তিনি তার সোর্সকে ব্যবহার করে পুরো তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে একটি প্রতিবেদন প্রচার করেন কাজ শুরুর প্রায় এক বছর পর।
তথ্য পেতে ‘সোর্স’ আর নানা কৌশলই সাংবাদিকদের ভরসা
বাংলাদেশে সচিবালয়, সংসদ সচিবালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশনসহ সরকারি নানা মন্ত্রণালয় বিভাগ বা দপ্তরের যেসব জায়গায় জনস্বার্থ সম্পর্কিত তথ্য উপাত্ত নির্ভর কাজ বেশি হয় সেখান থেকে তথ্য মূলত এভাবেই সংগ্রহ করেন সাংবাদিকরা।
সংসদের স্থায়ী কমিটি বা সংসদীয় কমিটিগুলোতে প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরকারের নানা বিভাগ থেকেই প্রতিনিয়ত নানা গোপনীয় প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয় যেগুলো গণমাধ্যমেও আসে। অথচ নির্দিষ্ট সভার পর সেসব প্রতিবেদন কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমে কর্মীদের দেয়া হয় না, যেমনি আসেনা সচিবালয়ে হওয়া অনেক সভার খবর। সচিবালয়ে কাজ করা একজন নারী সাংবাদিক বলছেন তথ্য পেতে সোর্সকে টাকা দেয়ার অভিজ্ঞতাও তার আছে। তবে তিনি তার নাম, পরিচয় প্রকাশে রাজি হন নি।
তিনি বলছিলেন “আমার সোর্স মন্ত্রী, সচিব, লিফট ম্যান এবং অফিস সহকারীসহ সব পর্যায়েই সোর্স মেনটেইন করতে হয়। আমি সত্যি বলতে আমাকে পয়সাও দিতে হয়। যার যতটুকু চাহিদা সেটা পয়সা বা অন্য কোনভাবে সহায়তা করা হোক – যে কোনভাবে কনভিন্স করা। যার মাধ্যমে আমি তথ্য পেতে পারি সেখানে সেই পন্থা নিতে হয়”।
“অনেক ক্ষেত্রে বলি কাগজ, ফটোকপি চাইনা – শুধু একটা ছবি তুলে পাঠান। আমি জানি জনস্বার্থেই এটা আমি করছি”। আরও ব্যাপক পরিসরে বড় ধরনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য এসব নানা কৌশলের চর্চা আছে বিশ্ব জুড়েই। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেই আলোচিত হয়েছে আল জাজিরায় টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।
বাংলাদেশের সেনা প্রধান ও তার ভাইদের নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে যাতে বেশ কিছু গোপন ফিল্মিং ও সূত্রের দেয়া তথ্য উপাত্ত দিয়ে। আবার ল্যাটিন আমেরিকায় গত দশকের শুরুতে বহুল আলোচিত ঘটনা ছিলো অপারেশন কার ওয়াশ যেটি পুরো ল্যাটিন আমেরিকায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকেই বদলে দিয়েছিলো বলে মনে করা হয়।
সেখানকার কয়েকটি দেশের সাংবাদিকদের সম্মিলিত অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছিলো অন্তত ১০জন সাবেক প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, গভর্নর, মন্ত্রী ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নাম, যারা কোটি কোটি ডলার ঘুষ নিয়েছেন।
২০১৬ সালে পানামার একটি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার ১ কোটি ১৫ লাখ নথি জার্মান একটি দৈনিকের হাতে আসলে তারা সেগুলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করা ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসকে (আইসিআইজে) দেয়।
এসব প্রতিবেদনে দেখা যায় বিশ্বের নানা ক্ষমতাধর রাষ্ট্রর রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান বা তাদের আত্মীয়রা অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষক শফিকুর রহমান বলছেন সত্য উদঘাটন করে সেই সত্যকে জনগণের সামনে উপস্থিত করতেই হবে। তবে এটা করতে গিয়ে কারও ক্ষতি করা যাবে না আর সাংবাদিককেও দায়িত্বশীল হতে হবে। তিনি বলেন এসব কারণেই অনুসন্ধানী সাংবাদিককে অনেক ক্ষেত্রেই নানা পন্থা অবলম্বন করে তথ্য আদায় করতে দেখা যায় উন্নত বিশ্বেও।
“ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট বা তথ্য বের করার প্রয়োজনে অনেক সময় ঘুষ বা অন্য রকম সুযোগ সুবিধা দিয়ে এ ধরণের তথ্য বের করার চেষ্টা হয়। এছাড়া জেলখানার ভেতরে গিয়ে বা লাইব্রেরীতে গিয়ে পুরনো দিনের তথ্য নিয়ে তারপর সেটা বিচার করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে অন্যায় পথ ফলো করা হয় না তা নয় কিন্তু সেটি করতে হয়”।
তিনি বলেন কোন তথ্য ক্লাসিফায়েড ঘোষণা না করা হলে বা আদালত যদি ক্লাসিফ্লায়েড বা রেস্ট্রিক্টেড ঘোষণা না করলে সেটি জানার অধিকার তো জনগণের আছে।
“ভেতরের খবর বের করে নিয়ে এসে জনসমক্ষে উপস্থিত করাই হলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রধান লক্ষ্য। সরকারের যে ডকুমেন্টস সেটা জনস্বার্থের ডকুমেন্টস। সেটা জনগণের তাতে অধিকার আছে এবং সেভাবে সাংবাদিকদের জনগণের সামনে তুলে ধরার দায়িত্ব আছে। তাই কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকলে ছবি তোলা তো অন্যায় নয়”।
তথ্য না পেলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কীভাবে হবে?
কিন্তু এসব করা না গেলে অর্থাৎ যে কোন উপায়ে যদি জনস্বার্থে ভেতরের খবর না আনা হয় তা হলে সাংবাদিকতার কি হবে? গণমাধ্যম কর্মীদের অনেকে মনে করেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিকল্প পন্থাগুলোর পথ রুদ্ধ হলে একদিকে তথ্য পাওয়া যেমন কঠিন হবে তেমনি দুর্নীতি বা অনিয়ম প্রতিরোধে ভেতর থেকে যারা তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে চান তারাও সাংবাদিকদের সহায়তা করতে সাহস পাবেন না, ফলে বাধাগ্রস্ত হতে পারে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা।
তবে এ ব্যাপারে ভিন্নমতও আছে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষক কাবেরী গায়েন বলছেন, সাময়িক সমস্যা এলেও সাংবাদিকরা কখনোই জনস্বার্থে তথ্য পেতে বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে আটকে থাকবেন না বলেই মনে করেন তিনি।
“কোন তথ্য জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট হলে সাংবাদিক চেষ্টা করবেন তা পরিবেশনের জন্য। সাংবাদিকরা এবার যেভাবে একত্রিত হয়েছেন তারা যদি স্থির থাকেন যে তারা সাংবাদিকতাই করতে চান, পিআর করতে চান না সেক্ষেত্রে ভালো করে রিপোর্ট তৈরি করবেন। জনস্বার্থে তথ্য বের করতে যার যার বিটে সোর্স তৈরি করে তারা প্রকৃত তথ্য বের করে নিয়ে আসবেন”।
আবার সাংবাদিকরাও অনেকে আশা করছেন যে পরিবেশ প্রতিকূল হলেও এর মধ্যে দিয়েই কাজের সুযোগ বের হবে। তবে নি:সন্দেহে এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে যে সাংবাদিকতার পরিবেশ কতটা থাকবে তার ওপর। আবার সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে যে মামলা করা হয়েছে সেই মামলার গতিপ্রকৃতি কোন দিকে যায় সেদিকেও অনেকের দৃষ্টি থাকবে।
বাংলা৭১নিউজ/ সূত্র: বিবিসি বাংলা