বাংলা৭১নিউজ রিপোর্ট: ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্টের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম কর্মীরা সোচ্চার হলেও সরকার এ বিষয়টিতে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। এই আইনটিকে কেন্দ্র করে গোটা গণমাধ্যম জুড়েই এক ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলেই সাংবাদিক নেতারা মনে করছেন। আর বাংলাদেশে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন ‘এডিটরস কাউন্সিল’ মনে করে, এই আইনের কারণে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অনেকাংশেই বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। এদিকে, আইনটি পাশ হওয়ার পর এ পর্যন্ত ২০টিরও বেশি মামলা হয়েছে। শুধুমাত্র গত এক মাসেই ৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করা হয়েছে। তবে ডাক, টেলিযোযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলছেন, এটি কার্যকর হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধেও এই আইনে মামলা করা হয়নি।
এই আইন নিয়ে সাংবাদিকদের উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরা হলে ডাক, টেলিযোযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বাংলা৭১নিউজ-কে জানান, ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট নিয়ে যারা চিৎকার করছের, প্রতিবাদ করছেন- তারা পুরো বিষয়টি উপলব্ধি না করেই করছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কোনভাবেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করার জন্য নয়; অথবা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জন্য কোনভাবেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। যদি আরও স্পষ্ট করে বলা হয়, তাহলে সেপ্টেম্বর ২০১৮-তে এই আইন পাশ করানো হয়েছে। কিন্ত আজ পর্যন্ত একটি মামলাও হয়নি।
তিনি বলেন, আমরা দেশটাকে ডিজিটালে রূপান্তর করবো। সেক্ষেত্রে এই ডিজিটাল দুনিয়াটাকে নিরাপদ করতে হবে। আর এই নিরাপদ করার জন্য যদি আইনগতকাঠামো না থাকে, তাহলে সরকার নিরাপত্তা দেব কোথা থেকে। আমাদের সিআরপিসি যেভাবে প্রচলিত অপরাধের জন্য কাজে লাগে, সেখানে ডিজিটাল অপরাধের জন্য যদি একটি আইন না থাকে, অথবা যদি কোন সংস্থা না থাকে, বিচার করার ব্যবস্থা না থাকে- তাহলে এই অপরাধের বিচার করবো কি দিয়ে।
মোস্তাফা জব্বার একটি অপরাধের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, সম্প্রতি জিগাতলায় একদল লোক জরো হয়ে ফেসবুকে গুজব ছড়ানো শুরু করলো যে- শত শত ছেলেমেয়েকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। মেয়েদেরকে র্যাপ করা হয়েছে। এই গুজবের বিরুদ্ধে আমরা যদি তাৎক্ষনিকভাবে ব্যবস্থা নিতে না পারি তাহলে এমন পরিস্থিতি সামাল দেব কিভাবে? অতএব এই পরিস্থিতি সামাল দেবার মত আইন থাকতে হবে। একটি দৈনিকে ছাপা হলো যে, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় বাহিনীর যৌথ অভিযান।’ ওই একই পত্রিকা আবার রিপোর্ট করলো ‘পুলিশের অভ্যন্তরে তৈরি হয়েছে হিন্দু লীগ।’ আইন না থাকলে এ ধরণের অপপ্রচার সরকার ঠেকাবে কিভাবে?
মন্ত্রী বলেন, সভ্যতার বড় বাহন হচ্ছে- ইন্টারনেট। এই ইন্টারনেটকে নিরাপদ রাখতে হবে। এই নিরাপদ মানে শিশুর জন্যও একে ব্যবহার উপযোগি করে তোলা। আমাদের শিশুরাও ইন্টারনেটে প্রবেশ করছে। তার সামনে যেন এমন কিছু না পরে, যেটা তার দেখা উচিত নয়। যেমন- পর্ণো কিম্বা এই ধরণের নোংরা কোন সাইট। ইন্টারনেটে আমাদের শিশুরাও যেন তার উপযোগি এবং তার প্রয়োজনীয় কনটেন্ট পেতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা পর্ণোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। এক্ষেত্রে পুলিশ সবচেয়ে বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এখন আইন না থাকলে আমরাতো পর্ণো সাইট বন্ধ করতে পারতাম না। আর নিশ্চয়ই সাংবাদিকরা চায় না যে, পর্ণো সাইট খোলা থাকুক। হ্যাঁ এটা ঠিক যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তখোনই প্রশ্ন তোলা যাবে- যখন এই আইনের ইচ্ছাকৃত অপব্যবহার করা হবে।
মন্ত্রী বলেন, আইনের অপব্যবহার কিন্ত সব আইনেই হয়। যেমন- নারী ও শিশু নির্যাতন আইনেরও ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে অপব্যবহার হয়েছে। যেকারো বিরুদ্ধে কেউ যেয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করে দিল। এটা হতেই পারে। এর প্রতিকারও রয়েছে। আমাদেরকে দেখতে হবে, রাষ্ট্র যেন কোনভাবেই সাংবাদিক দমনের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ব্যবহার না করে। আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি, এই আইন সংবাদপত্র কিম্বা গণমাধ্যম কিম্বা কোন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অপব্যবহার করার জন্য নয়। এরকম অপব্যবহারের কোন ঘটনা ঘটলে আপনারা আমাকে জানাবেন। আমি এ ব্যপারে অবশ্যই সাংবাদিকদের পাশে থাকবো।
এদিকে এই আইনটি নিয়ে এডিটরস কাউন্সিল এর সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ আনাম সম্প্রতি বিবিসিকে বলেছেন, এর ফলে গণমাধ্যম-কর্মীদের কাজের সুযোগ সংকুচিত হয়ে যাবে। এই আইনের ৩২ ধারায় বলা আছে ডিজিটাল মাধ্যমে সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গ করা হলে ১৪ বছরের সাজা। এখন সরকারি গোপনীয়তা কী? যে কোন জিনিষ যেটা সরকার অফিসিয়ালি জনগণকে জানাচ্ছে না, সেটাই তো সিক্রেট থেকে যাচ্ছে। এই আইন অনুযায়ী সেটা তো জনগণের জানার অধিকার নেই। কারণ সরকার সেটা জানাচ্ছে না। কিন্তু সাংবাদিকদের তো সেটা জানাই ২৪ ঘণ্টার কাজ। এটা তো স্টেট সিক্রেট হওয়ার ফলে আমি তো আর এখানে সাংবাদিকতা করতে পারবো না।
তার মতে, পরোয়ানা ছাড়াই আইনের ৪৩ ধারায় তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতারের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তাতেও চাপের মুখে পড়বেন গণমাধ্যম-কর্মীরা। এই ধারায় কোন পুলিশ অফিসার যদি মিডিয়া অফিসে এসে তল্লাশি করেন এবং মনে করেন যে তদন্তের স্বার্থে আমার অফিসিয়াল সার্ভারে তার ঢোকা দরকার এবং তিনি যদি সার্ভার জব্দ করেন, তাহলে অপরাধের আলামত থাকুক আর না থাকুক সার্ভার জব্দ হওয়ায় ঐদিনের প্রকাশনা তো বন্ধ রাখতে হবে। এটা কয়েকদিনও বন্ধ থাকতে পারে। এমনকি সরকার কোন খবরের কাগজ বন্ধ করার আদেশ না দিয়েও কাগজটা বন্ধ করে দিতে পারেন শুধু সার্ভারটা যদি উনারা কব্জা করে নেন। এছাড়াও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৪টি ধারা রয়েছে অ-জামিনযোগ্য।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাবেক সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা বলেন, সাংবাদিকরা এই আইন বাতিলের ব্যপারে শুরু থেকেই দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্ত সরকার কেন বাতিল করছে না তা বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই এই আইনের আওতায় অনেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। অনেকে জেলে রয়েছেন। এই আইনের কারণে স্বাধীন সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্থ হবে। তিনি বলেন, কোন সাংবাদিক অপরাধ করলে প্রচলিত আইনেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এজন্য এমন ভীতিকর আইনের প্রয়োজন নেই।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচবি