প্রতিনিয়তই যেন আতঙ্ক নিয়ে বাস করতে হয় রাজধানী ঢাকায়। সেই আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়ে গেল শুক্রবার (৫ মে) সকালের ভূমিকম্প, যা অনুভূত হয়েছে ঢাকাসহ এর আশপাশের বিভিন্ন জেলায়।
সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো, ভূমিকম্পটি ৪ দশমিক ৩ মাত্রার হলেও এর উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার একদম কাছেই, দোহারে। আর উৎপত্তিস্থল এত কাছে হওয়ায় প্রশ্ন উঠছে, ঢাকা কি তাহলে আরও শক্তিশালী ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) বলছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার কাছে বিক্রমপুরের দোহার থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। এর কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে।
উৎপত্তিস্থল ঢাকার অদূরে এবং ভূপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি হওয়ায় উদ্বেগ জানিয়েছেন ভূতত্ত্ববিদরা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, এর আগে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ভূমিকম্প আমরা লক্ষ করেছি, সেগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৫-৪০ কিলোমিটার গভীরে উৎপত্তি হয়েছে। এই ভূমিকম্পটি সেগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত অনেকটাই অগভীর।
অবশ্য আবহাওয়া অধিদফতরের সহকারী আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানার মতে, বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। আর এ ধরনের ছোট ছোট ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল সাধারণত কাছাকাছি জায়গায় হয়ে থাকে।
সম্প্রতি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, বিশ্বের ২০টি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। রিখটার স্কেলে যদি ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তা হলে ধসে পড়বে প্রায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন। মৃত্যু হবে ২ লাখ ১০ হাজার মানুষের, আহত হবেন ২ লাখ ২৯ হাজার মানুষ।
বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৮৭ বার ভূকম্পন হয়। এতে মারা যান ১৫ জন। যার মধ্যে ১৩ জনেরই মৃত্যু হয় আতঙ্কে। প্রাণহানিসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ শহরাঞ্চলেই বেশি। ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সারা দেশে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৪৯৬ কিলোমিটার দূরের সিকিম-নেপাল সীমান্তে। ১৮৫৭ সালের পর ঢাকার এত কাছে আর কোনো ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো স্থানে ভূকম্পনের জন্য ফল্টলাইনের বড় ভূমিকা রয়েছে। ভূতত্ত্বের বিশাল খণ্ডকে টেকটোনিক প্লেট বলা হয়। আর দুটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝে থাকা ফাটলকে ফল্ট বা চ্যুতি লাইন বলা হয়। ফল্টলাইন দিয়ে ২ প্লেটের সংঘর্ষ হলে ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশের মূল ভূভাগসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় এ রকম কয়েকটি ফল্ট রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক তাদের গবেষণায় জানান, বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চল এবং মিয়ানমারের কিছু অংশে প্রচণ্ড শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প হতে পারে।
নেচার জিওসায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই গাবেষণায় আরও বলা হয়, বাংলাদেশসহ ভারত ও মিয়ানমারের কিছু অংশজুড়ে একটি সুবিশাল চ্যুতির (ফল্ট) অবস্থানের কারণে এ এলাকায় রিখটার স্কেলে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এ রকম দুর্যোগে ঢাকাসহ বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও বিপুল প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। ফল্ট এলাকার আশপাশের ১০০ কিলোমিটার এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের উপপরিচালক (ভূতত্ত্ব) ও ভূমিকম্প গবেষক আক্তারুল আহসান সময় সংবাদকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ভূমিকম্প হবে কি না, এ নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে, গবেষণা সেটাই বলে। আমরা যেসব ডাটা অ্যানালাইসিস করেছি তাতে জানা গেছে, বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকেম্পর আশঙ্কা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্প হলে কত মাত্রার হবে, এটা নিয়ে কনট্রোভার্সি (বিতর্ক) রয়েছে। অনেকেই বলছে ৮ মাত্রার ওপরে যাবে, কেউ বলছে ৭ মাত্রার, আবার কেউ বলছে ৬ মাত্রার হবে। তবে বাংলাদেশের মাঝের পার্টটাতে যে পরিমাণ শক্তি জমা হয়ে আছে, তাতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। তবে সেই পরিমাণ শক্তি একবারে নির্গত হবে কি না, সেটা নির্ভর করবে আমাদের উইক জোনের ওপর।’
তবে এ গবেষণার বিষয়ে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে বাংলাদেশ ভূমিকম্প সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী জানান, এ গবেষণায় যে ফাটলরেখা দেখানো হয়েছে, তার বাইরেও একটা ফাটলরেখা মিয়ানমারের সমান্তরালে চলে গেছে। সেখানে গত কয়েক শতাব্দীতে বড় ধরনের অনেক ভূমিকম্প হয়েছে। কিন্তু এই গবেষণায় যে ফাটলরেখা দেখানো হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের প্রায় মাঝ বরাবর চলে গেছে। এই রেখার ওপর অতীতে কোনো বড় ভূমিকম্প হওয়ার তথ্য মেলেনি।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে গ্লোবাল আর্থকোয়েক মডেল-এ প্রকাশিত এক গবেষণার বরাত দিয়ে বুয়েটের এ অধ্যাপক বলেন, ‘বাংলাদেশের উত্তরে ভুটান এলাকায় ২৫ কিলোমিটার লম্বা একটি ফাটলরেখা আছে। সেখানে যেকোনো সময় ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে।’
বাংলা৭১নিউজ/আরএম