বাংলা৭১নিউজ রিপোর্ট : ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এর সঙ্গে দেখা দিয়েছে চিকিৎসা সংকট। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে তিলধারণের ঠাঁই নেই। দুই-তৃতীয়াংশ রোগীকেই হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভর্তি করা রোগীর ৮০ ভাগই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এ বছর ধনীরাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। অন্য বছরগুলোতে ডেঙ্গুতে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যদের আক্রান্তের হারই বেশি ছিল। কর্মক্ষম মানুষের ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় অনেক পরিবার আর্থিক সংকটে পড়েছে।
রাজধানীর সীমানা পেরিয়ে ডেঙ্গু পৌঁছে গেছে চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল বিভাগেও। রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। দেশের ডেঙ্গুর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে একে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
অন্যদিকে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে রোগীর স্বজনরা।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, ক্রিটিক্যাল ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালেও ১ লাখ টাকার ওপরে ব্যয় হচ্ছে। স্কয়ার ও আজগর আলী হাসপাতালে ৩ লাখ থেকে ৯ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে এমন উদাহরণও রয়েছে। ডেঙ্গুতে শিশুদের চিকিৎসা ব্যয় আরও বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুরা ডেঙ্গুর ভয়াবহতায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এ নিয়ে ইতোমধ্যে বেসরকারি মেডিকেল, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার ফি নির্ধারণ এবং তা সবার সাধ্যের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
রাজধানীর হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। বেশিরভাগ হাসপাতালে শয্যা খালি নেই। ফ্লোরে রেখেই রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ফ্লোরে রেখে ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেওয়া হলেও বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। কোনো কোনো হাসপাতালে ওয়ার্ডের বিছানায় ও বারান্দায়ও রোগীদের চিকিৎসা চলছে। জরুরি অবস্থায় রোগী নিয়ে যেতে হচ্ছে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে। পার্থক্য এই যে, শয্যা না থাকলে বেসরকারি হাসপাতাল রোগী ভর্তি করে না। আর সরকারি হাসপাতাল কোনো রোগী ফেরত দিচ্ছে না। বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, অবস্থা জটিল না হলে হাসপাতালে ভর্তির দরকার নেই, বাসায় রেখেই চিকিৎসা সম্ভব।
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে তানিয়া সুলতানা (২৮) নামে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক নারী চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিন চিকিৎসকের মৃত্যু হলো।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা এখন পর্যন্ত মাত্র ৮ জন বলা হলেও বেসরকারি হিসাবে এ মৃতের সংখ্যা কমপক্ষে তিন গুণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবার ডেঙ্গু মহামারীর আকার ধারণ করেছে। মৃত্যুর সংখ্যা জনজীবনে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ঢাকা থেকে ডেঙ্গু এখন দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। পুরো দেশে মশা নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হওয়া প্রসঙ্গে মশা বিষয়ক গবেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, এবার ফেব্রুয়ারি মাসে বৃষ্টি হয়েছে। এডিস মশার ডিম বা লার্ভা ছয় মাস পর্যন্ত শুকনো স্থানে থাকলেও বেঁচে থাকতে পারে। আগে বৃষ্টি এবং এখনও থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে সেসব লার্ভা থেকে এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে। এজন্য মশার ঘনত্ব বাড়ছে। অথচ ডেঙ্গুর মৌসুম সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর এখনও বাকি। তাই আগামী দু’মাসে এর ভয়াবহতা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কার কথা জানান তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ৩৯০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। ছুটির দিন শুক্রবারে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি এমনটিই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মহাখালীর বেসরকারি ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ কুমার চক্রবর্তী জানান, শিশুরা জটিল অবস্থায় আসছে। কেউ আসছে কয়েকটি হাসপাতাল ঘোরার পর। সব রোগীকে হাসপাতালে জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। তিনি জানান, এই হাসপাতালে পিসিআইইউ শয্যা রয়েছে ১৪টি। সব কটিতেই এখন রোগী আছে। তাই অনেক রোগীকে ভর্তি করা সম্ভব হয়নি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর জন্য নির্ধারিত শয্যা ৬০। অথচ চিকিৎসাধীন ১৩৩ জন। শয্যা না থাকায় বাড়তি রোগীকে হাসপাতালের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর জন্য বরাদ্দ আছে ১২টি শয্যা, এখন ভর্তি আছে ৬০ শিশু।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ মহামারীর আকার ধারণ করছে। এক্ষেত্রে জনগণের অসচেতনতা এবং সিটি করপোরেশনের মশা মারার ওষুধ কার্যকর নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, এবারের ডেঙ্গুর ধরন ভিন্ন। জ্বর হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ