বাংলা৭১নিউজ,ঢাকা: ভিশন ২০২১ এর আগেই প্রত্যেক ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে চায় বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। অবিদ্যুতায়িত ২১ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুত সংযোগের আওতায় আনতে পারলেই প্রতিষ্ঠানটি তাদের ভৌগলিক সীমায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে বলে ঘোষনা দেবে। চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যেই এই লক্ষ্য অর্জন করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। আরইবি’র বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা ২ কোটি ৪৯ লাখ ৫০ হাজার। পরিকল্পনা অনুযায়ি, প্রতিষ্ঠানটি দেশের ৪৬১টি উপজেলায় গ্রাহক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ২ কোটি ৭০ লাখ। এই হিসাবে আরইবি ৯২ শতাংশ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এনেছে।
আরইবি’র পরিকল্পনা থেকে জানা যায়, চলতি বছর ডিসেম্বরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পর গ্রাহক সেবার মান আরও বৃদ্ধির ওপর জোর দেবে। এজন্য পরবর্তি পরিকল্পনাও ঠিক করেছে প্রতিষ্ঠানটি। যার মধ্যে রয়েছে- বেশি বেশি বিদ্যুৎ লোড সক্ষমতা অর্জন, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করা, আরও দক্ষ জনবল গড়ে তোলা, স্মার্ট প্রিপেইড কার্ড চালু, সাব স্টেশন লাইনগুলো ঝুঁকিমুক্ত করা এবং নতুন লাইন নির্মাণ, নতুন সাব স্টেশন নির্মাণ ও পুরানো সাব স্টেশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্কাডা সিস্টেম চালু ও স্মার্ট গ্রীড নির্মাণ করা।
গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দিতে আরইবি’র আজকের এই সফলতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন (অব:) বাংলা৭১নিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন, আরইবি সেই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ কওে যাচ্ছে। তিনি বলেন,বর্তমানে আরইবির ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সমগ্র বাংলাদেশে গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুতায়নের কাজ করছে। আরইবি’র বর্তমান বিদ্যুতের চাহিদা ৬ হাজার ৫শ’ মেগাওয়াট। যা দেশে উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের ৫৫ শতাংশ।
মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন (অব:) বলেন, প্রতিষ্ঠানটির মাসিক বিদ্যুৎ বিক্রির পরিমান ১ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা। তিনি জানান, আরইবি সাড়ে ৩ লাখ সেচ পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগ, ৪ লাখ ২৬ হাজার কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ, ১০ হাজার ৫৩৩টি এসডিএ ক্ষমতা সম্পন্ন ৮৮০টি সাব স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে এবং সিস্টেম লস ১১ শতাংশে নামিয়ে এনেছি।
বিআরবি লাভজনক প্রতিষ্ঠাণ কীনা জানতে চাইলে মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন (অব:) বলেন, আমরা নো লস, নো প্রফিটে রয়েছি। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার কৃষক বান্ধব সরকার। কৃষিতে আমরা ভর্তুকী দামে বিদ্যুৎ দিচ্ছি। বিদ্যুৎ ক্রয় ও রক্ষনাবেক্ষন চার্জ মিলিয়ে প্রতি ইউনিটের দাম পড়ে ৬ টাকা ২৯ পয়সা। সেখানে আমরা প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করি চার টাকায়। এর মধ্যে কৃষক দেয় ৩ টাকা ২০ পয়সা এবং সরকার দেয় ৮০ পয়সা। এক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটে আমাদের লোকসান ২ টাকা ২৯ পয়সা। তিনি বলেন, বিআরইবি’র আড়াই কোটি গ্রাহকের ৪৫ শতাংশই লাইফ লাইন গ্রাহক। এদের কাছে আমরা প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৩ টাকা ৬০ পয়সায় বিক্রি করি। আমাদের ৮০টি সমিতির মধ্যে মাত্র ১৭টি সমিতি লাভজনক অবস্থায় রয়েছে। এসব সমিতির লাভের সমুদয় অর্থই লোকসানী সমিতিগুলোর মাঝে বন্টন করা হয়।
আরইবি চেয়ারম্যান বলেন, পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমের ইতিবাচক প্রভাব দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখছে। ফলে দেশের পল্লী অঞ্চলে শিল্পায়নের বিকাশ ঘটায় বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, আর্থিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি, দেশের শিক্ষার হার ও সুযোগ বৃদ্ধি সহ গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রযুক্তির প্রসার ঘটেছে। এছাড়া কৃষি বিপ্লবের কারণে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্নতা অর্জন করেছে। গ্রামীন দারিদ্র উল্লেখ্যযোগ্যহারে হ্রাস পেয়েছে। ২০১৯ সালের মধ্যে যাতে দেশের সকল উপজেলা শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা যায় এজন্য ৫০ হাজার কিলোমিটার লাইন নির্মাণ এবং ১৯৮টি উপকেন্দ্র নির্মাণ করে ১৫৫০ এমভিএ ক্ষমতা বৃদ্ধিও কাজ চলমান রয়েছে। এই কাজ সম্পন্ন করার মধ্যে দিয়ে আরইবি চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে ২১ লাখ গ্রাহককে সংযোগ প্রদান করবে। আর এটা করতে পারলে আরইবি’র ভিশন ২০২১ কার্যক্রমের সফল সমাপ্তি হবে।
মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন (অব:) বলেন, বর্তমানে আরইবির ১৮টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। সরকারের পাশাপশি বিশ্বব্যাংক, এডিবি সহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগি সংস্থা আমাদের বিভিন্ন প্রকল্পে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। আরইবি’র স্বচ্ছতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রমের আওতায় আরইবি অনলাইনে বিদ্যুৎ সংযোগ আবেদন গ্রহণ করছে। এসএমএস, ইউডিসি (ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার)ও অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারছেন। ই-জিপি’র মাধ্যমে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ২৭০৪টি ক্রয়কার্য সম্পন্ন করা হয়েছে।
আরইবি চেয়ারম্যান আরও জানান, ইজিবাইক ও ব্যাটারি চালিত রিক্সার ব্যাটারি চার্জিং এর জন্য ১৪টি সোলার চার্জিং স্টেশন নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট ২টি চার্জিং স্টেশনের নির্মাণ কাজ আগামী ২ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা হবে। তিনি বলেন, ১৫টি উপজেলা সদরের প্রত্যেকটিতে ৩০ কিলোওয়াট পিক ক্ষমতাসম্পন্ন সোলার চার্জিং প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ৪০টি সোলার সেচ পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। আর ২০০০টি সোলার সেচ পাম্প স্থাপনের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ত্রিশটি নেট মিটারিং ও ৬টি গ্রীড চাজিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ৪৬১টি উপজেলার মধ্যে ৩০৫টি উপজেলাকে শতভাগ বিদ্যুতায়িত করা হয়েছে। অবশিষ্ট ১৫৬টি উপজেলা চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যেই শতভাগ বিদ্যুতায়িত করা হবে।
আগামী গ্রীস্মে আরইবির বিদ্যুৎ চাহিদা কত জানতে চাইলে মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন (অব:) বলেন, ৮ হাজার মেগাওয়াট আমাদের চাহিদা থাকবে। আর এই পরিমান বিদ্যুৎ আমাদের দেওয়া হলে তা নেওয়ার মত সক্ষমতা আরইবির রয়েছে। মাটির নিচ দিয়ে লাইন নেওয়ার পরিকল্পনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেরানীগজ্ঞ, মুন্সিগজ্ঞ, গাজীপুর, মানিকগজ্ঞ, নারায়নগজ্ঞ, নরসিংদী, সাভার ও টাঙ্গাইলের ওভারহেড লাইন (ওপরের লাইন) আন্ডারগ্রাউন্ড (মাটির নিচ দিয়ে) করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসাবে কেরানীগজ্ঞের ওপরের লাইন সরিয়ে নিচ দিয়ে নেওয়ার জন্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়সম্বলিত ডিপিপি তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে একদিকে যেমন শহরের সুন্দর্য বৃদ্ধি পাবে, তেমনি অনেক ঝুঁকিও হ্রাস পাবে।
‘আলোর ফেরিওয়ালা’ কর্মসূচি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন (অব:) বলেন, এটি ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডে চালু করা হয়। এখন সকল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকেই এই কর্মসূচি চালুর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এর মধ্যে দিয়ে গ্রাহক ৫মিনিটের মধ্যেই উপকৃত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আলোর ফেরিওয়ালা কর্মসূচিতে স্বত:স্ফূর্তভাবে বাড়ী বাড়ী যেয়ে ওয়্যারিং সম্পন্ন ও জামানত জমার পর ৫ মিনিটের মধ্যেই মিটার লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ উদ্যোগ ৮০টি সমিতির মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
আরইবি চেয়ারম্যান বলেন, এখন আমাদের ভিশন হচ্ছে ২০৪১। এই ভিশনকে সামনে রেখেই আরইবি মেগা পরিকল্পনা প্রনয়ন করছে। এপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে আরইবি’র বিদ্যুতের চাহিদা সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট। ২০২১ সালে এই চাহিদা হবে সাড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াট, ২০৩০ সালে চাহিদা হবে ১৯ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালে আরইবি’র বিদ্যুৎ চাহিদা হবে ৩৬ হাজার মেগাওয়াট। লাইন নির্মাণ, সাব স্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনাসহ টেকসই অবকাঠামো নির্মানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।
মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন (অব:) বলেন, লক্ষ্য যেহেতু আমরা নির্ধারণ করেছি। বাস্তবায়নও আমরা করবোই। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ হচ্ছে- স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সততা ও উত্তম গ্রাহকসেবার মাধ্যমে আরইবিকে তার অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা অনুযায়িই কাজ করে যাচ্ছি।
নতুন বছরের শুরুতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোন প্রস্তাব আছে কীনা জানতে চাইলে আরইবি চেয়ারম্যান পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, একটি নতুন সরকার গঠন হয়েছে। দায়িত্ব নিয়েই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মত সিদ্ধান্ত এই সরকার কেন নেবেন?
নসরুল হামিদ বিপু পুনরায় বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ায় তিনি বলেন, এর ফলে আরইবি’র গৃহিত পরিকল্পনাগুলো এগিয়ে নেওয়াটা আরও অনেক সহজ হবে এবং তার সুযোগ্য নেতৃত্বে আরইবি আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
বাংলা৭১নিউজ/সাখাওয়াত হোসেন বাদশা