ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসি এলাকায় মেট্রোরেলের পিলারে থাকা ঘৃণা ও ক্ষোভমিশ্রিত শেখ হাসিনার ছবি শনিবার মধ্যরাতে মুছে ফেলার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করে গতকাল রাতেই নানা স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ জানান শিক্ষার্থীরা।
সে সময় মুছে ফেলা সেই গ্রাফিতির ওপর নতুন করে শেখ হাসিনার অন্য একটি গ্রাফিতি আঁকেন একদল শিক্ষার্থী।
ওই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ জানান, গোয়েন্দা সংস্থার পরামর্শে এবং তার সম্মতিতে এ গ্রাফিতি মুছে ফেলার কাজটি করেছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ, তবে এটি তার ভুল হয়েছে। কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নয়, নিষ্পাপ এবং সরল চিন্তায় এটি করার অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি।
এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যেভাবে চাইবে সেভাবেই এই গ্রাফিতি আঁকা হবে এবং এর যাবতীয় খরচ বহন করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এটিকে ঘৃণাস্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন এবং এই ঘৃণা স্তম্ভ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য উদ্বোধন করবেন বলেও জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর।
টিএসসির মেট্রোরেল স্টেশন উদ্বোধনের সময় মেট্রোরেলের পিলারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনার ছবি আঁকে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগ।
গত ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণার পর এবং ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর পিলারে থাকা এসব গ্রাফিতিতে ছাত্র-জনতা লাল রঙের ছোপ, কাদামাটি এবং জুতা নিক্ষেপ করে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করে।
পরে পিলারে উঠে সেই গ্রাফিতির সঙ্গে জুতার মালা সংযুক্ত করে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। সে সময় থেকে গতকাল পর্যন্ত সেভাবেই ছিল গ্রাফিতিটি। এটিকে ঘৃণাস্তম্ভ হিসেবেই মনে করে এসেছে শিক্ষার্থীরা।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘৃণাস্তম্ভে থাকা গ্রাফিতি গতকাল রাত দুইটার দিকে মুছে ফেলার সময় বিষয়টি দুই শিক্ষার্থী প্রথমে লক্ষ করেন। গ্রাফিতি মুছে ফেলার কারণ জানতে চাইলে এবং কাজটি বন্ধ করতে বললে ঘটনাটি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এবং গ্রাফিতি মোছার দায়িত্বরতদের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয়।
এরপর শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি ছড়িয়ে দেন। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ঘটনাস্থলে এসে মুছে ফেলার কারণ ও অনুমতির বিষয়টি জানতে চান।
মেট্রোরেলের এক কর্মকর্তা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে এটি করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা এতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এরপর ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং স্টেট অফিসের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ফাতেমা বিনতে মোস্তফা।
প্রক্টরের ভাষ্য
গ্রাফিতি মুছে ফেলার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আমাকে বলা হয়েছে, তারা যখন রাজু ভাস্কর্যে হওয়া বিভিন্ন প্রোগ্রামের ছবি তুলতে যান, তখন পেছনে শেখ হাসিনা এবং শেখ মুজিবের ছবি চলে আসে।
তারা আমাকে জানায়, এই ক্যাম্পাসে শেখ হাসিনা আর শেখ মুজিবের ছবি কেন থাকবে স্যার? এগুলোসহ নানা কথা বললে আমি খুবই ইনোসেন্ট চিন্তা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসকে বললে তাদের কনসার্নে মেট্রো কর্তৃপক্ষ এসব গ্রাফিতি মুছে ফেলে।
‘পরে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানালে আমরা তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছি এবং নতুন ছবি আঁকতে রঙের যাবতীয় খরচ বহন করেছি। এখন শিক্ষার্থীরা যদি চায় আগের গ্রাফিতিই ফিরিয়ে আনা হবে। এটি করতে যা যা খরচ দরকার সেটিও আমরা বহন করব এবং এটিকে অফিশিয়ালি ঘৃণাস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করব। একটু পরেই আমরা বিবৃতি দেব।’
পরবর্তী সময়ে প্রক্টর অফিসের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা অতি দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, গতকাল গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পেছনে মেট্রোরেলের দুটি পিলারে থাকা শেখ মুজিব এবং স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ঘৃণাসূচক গ্রাফিতি মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। জুলাই আন্দোলনে এই দুটি গ্রাফিতি বিপ্লব, প্রতিরোধ এবং ফ্যাসিবাদ ধ্বংসের প্রতিনিধিত্ব করে। এই স্মৃতিকে তাজা রাখা এবং প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়া আমাদের দায়িত্ব।’
এটি প্রক্টরিয়াল টিমের অনিচ্ছাকৃত ভুল উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এ জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে আমরা আরও সতর্ক থাকার অঙ্গীকার করছি।’
স্তম্ভটিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘৃণাস্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘প্রক্টরিয়াল টিমের উপস্থিতিতে গত রাতেই শিক্ষার্থীরা মুছে ফেলা গ্রাফিতি অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে এঁকেছেন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার এই ঘৃণাকে যুগ যুগ ধরে সংরক্ষণের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গ্রহণ করবে।’
প্রতিবাদ
গ্রাফিতি মুছে ফেলার ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাসহ প্রতিবাদ জানিয়েছেন ছাত্রদলের নেতারাও।
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন নাসির বলেন, ‘অভ্যুত্থানের চিহ্ন মুছে ফেলার অর্থ ইতিহাসের সাক্ষী মুছে ফেলা। পরাজয়ের ইতিহাস মুছে ফেলার তাড়না থাকে কেবল পরাজিত শক্তির। ফ্যাসিস্টের পতনের চিহ্ন মুছে ফেলার ধৃষ্টতা বরদাশত করা হবে না।
‘এই ষড়যন্ত্র কোনোভাবে সফল হবে না। গণহত্যাকারীদের পরাজয়ের গ্লানি ও মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার বিজয়ের আলেখ্য বারবার নতুন রূপে উদ্ভাসিত হবে।’
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ