বর্ষায় চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার পাহাড়ি প্রাকৃতিক ঝরনাগুলো যৌবন ফিরে পাওয়ায় ভ্রমণপিপাসুরা ছুটছেন তা প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পর্যটক যাচ্ছেন ঝরনার রানি হিসেবে খ্যাত খৈয়াছড়া ঝরনায়। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে যাচ্ছেন সেখানে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোরবানের ঈদের দিন বিকেল থেকে সব ঝরনায় মানুষের ঢল নামে। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত ছুটে যাচ্ছেন সব বয়সী পর্যটকরা। দলবেঁধে বন্ধু-বান্ধব, পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় স্বজনরা ছুটছেন ঝরনার রূপ গিলতে। ঝরনার শীতল পানিতে শরীর ভিজিয়ে অন্যরকম আনন্দ পাচ্ছেন তারা।
সবচেয়ে বেশি পর্যটক ছুটছেন খৈয়াছড়া ঝরনায়। যেখানে প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি সেতুবন্ধন করে। সবুজের চাদরে ঢাকা বনানী রূপের আগুন ঝরায়। প্রকৃতি খেলা করে আপন মনে, ঝুমঝুম, ছলাৎ-ছলাৎ শব্দে বয়ে চলা ঝরনা ধারায় গা ভিজিয়ে মানুষ যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ থেকে নিজেকে ধুয়ে ফেলে সজীব করে।
পাহাড়ের সবুজ রং আর ঝরনার স্বচ্ছ পানি মিশে মিশে একাকার হয়েছে প্রাকৃতিক আট স্তর বিশিষ্ট এ ঝরনায়। প্রকৃতির নান্দনিক তুলিতে আঁকা এ ছবি দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন দেশের ভ্রমণপিপাসুরা। এই ঝরনা দেখতে এসে মুগ্ধ হচ্ছেন দেশ বিদেশের পর্যটকরা।
যাতে সত্যিই হতবাক হচ্ছে না কেউ এখন। কারণ ঝরনার পাশে গেলে দর্শনার্থীরাও অবাক হচ্ছে এজন্য যে, এখানকার পাহাড়ি অরণ্যে এতোকাল লুকিয়ে ছিল এমন নান্দনিক অপরূপ সুন্দর ঝরনা।
বর্ষাকালে ঝরনার আকর্ষণ অন্য সময়ের তুলনায় বাড়তি থাকে। তবে শীত ও গরমে এর আকর্ষণের কমতি নেই। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সব মৌসুমেই উপভোগ করা যায়। তাই প্রতিনিয়ত পর্যটকদেরও ঢল নামে। বিশেষ করে ছুটির দিনে ৩-৪ হাজার পর্যটকের সমাগম ঘটে এই ঝরনায়।
মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর পার্শ্বে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৪.২ কিলোমিটার পূর্বে ঝরনার অবস্থান। এর মধ্যে এক কিলোমিটার পথ গাড়িতে যাওয়ার পর বাকি পথ যেতে হবে পায়ে হেঁটে। বাঁশের সাঁকো, ধানক্ষেত, আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি পথ, ছড়া ও পাহাড় পেরিয়ে যেতে হবে প্রকৃতির এই বিস্ময় সান্নিধ্যে।
খৈয়াছড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাহেদ ইকবাল চৌধুরী জানান, ‘স্থানীয় ভুঁইয়া টিলা নামক স্থানে প্রায় ৫০ বছর ধরে প্রবাহিত হচ্ছে ঝরনাটি। পাহাড়ি ঝোঁপের কারণে মানুষ তখন খুব একটা ওই জায়গায় যেত না। গত ৫-৬ বছর থেকে সেখানে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, খৈয়াছড়া ঝরনা এলাকায় পর্যটকের ঢল নেমেছে। ঝরনার রাস্তার মাথায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি বাস, অনেকগুলো মাইক্রো, হাইস, নোহা, প্রাইভেটকার।
এসব গাড়ি করে সবাই ছুটে এসেছেন ঝরনায় যাওয়ার জন্য। এর চেয়ে বেশি পর্যটক আসছেন বিভিন্ন যাত্রীবাহী বাসে করে। রাস্তার মুখে নেমে সিএনজি চালিত অটোরিকসা যোগে তাঁরা ছুটে যাচ্ছেন ঝরনায়।
পুরান ঢাকা থেকে ৮ বন্ধু মিলে ঝরনা দেখতে এসেছেন কলেজ ছাত্র জাবের হোসাইন। তিনি বলেন, ‘দেশের বিখ্যাত অনেক প্রাকৃতিক ঝরনা আমি দেখেছি। খৈয়াছড়া ঝরনার যে সৌন্দর্য তা দেশে দ্বিতীয়টি আর আছে কি না আমার জানা নেই।’
খৈয়াছড়া ঝরনার ৮টি স্তর আছে। বেশিরভাগ পর্যটক প্রথম ধাপের সৌন্দর্য দেখেই মাতোয়ারা। পাহাড়ের উঁচুতে হওয়ায় বাকি ধাপগুলোতে যাওয়া কিছুটা কষ্টকর বলে অনেকেই ঝরনার প্রথম ধাপের সৌন্দর্য দেখেই ফিরে আসেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঝরনার শেষ ধাপ পর্যন্ত ঘুরে আসা পর্যটক মেহেদি হাসান নয়ন বলেন, ‘অনেক প্রশস্ত জায়গাজুড়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে শেষ ধাপে। ঝরনার শেষ ধাপ পর্যন্ত যারা আসবেন তারা বাংলাদেশের সেরা কোনো প্রাকৃতিক ঝরনা উপভোগ করবেন নিঃসন্দেহে।
কুমিল্লা থেকে আসা দম্পতি ইমরুল কায়েস ও মাকসুদা আকতার বলেন, ‘অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে ঝরনায় আসতে। পাহাড় আর ঝরনার সৌন্দর্যে তারাও খুব মুগ্ধ। তবে রাস্তার অসুবিধার কারণে ঝরনার আসা কষ্টসাধ্য বলে মন্তব্য করেন এই পর্যটক দম্পতি।
চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগ বারৈয়াঢালা রেঞ্জের আওতাধীন ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের জন্য এ ঝরনাসহ ৫টি ঝরনা ইজারা পেয়েছেন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান শোমোশন লিমিটেড।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তন্ময় ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে আমাদের প্রতিষ্ঠান ভ্যাটসহ প্রায় ৪০ লাখ টাকা দিয়ে বারৈয়াঢালা রেঞ্জের আওতাধীন ৫টি ঝরনা ইজারা নিয়েছে।
এখন সব ঝরনায় মানুষ যাচ্ছে। আমরা প্রতি টিকেট ২০টাকা বিক্রি করছি। তবে বেশি মানুষ যাচ্ছেন খৈয়াছড়া ঝরনায়। একদিনে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৫০০ পর্যটক ঝরনা গেছেন।
কীভাবে যাবেন?
দেশের যে কোনো স্থান থেকে বাসে উঠে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর পাশে ঝরনার রাস্তার মুখে নামতে হবে। মহাসড়ক থেকে নেমে পুর্বদিকে গ্রামের রাস্তা ধরে ১০ মিনিট হাঁটলে পথে রেললাইন পড়বে।
রেললাইন পার হয়ে আরও ১০ মিনিট হাঁটলে ঝিঁরি পাবেন। ইচ্ছে করলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে ঝিরি পর্যন্ত আপনি সিএনজি নিয়ে (ভাড়া পড়বে ৭০-৮০ টাকা) যেতে পারবেন।
সেখান থেকে আপনাকে খৈয়াছড়া ঝরনার মূল ট্র্যাকিং শুরু করতে হবে। প্রয়োজন হলে সেখান থেকে গাইডও নিয়ে নিতে পারেন। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাহাড়ি ঝিরিপথ ধরে প্রায় দেড় ঘণ্টা হাঁটলে দেখা পাবেন ঝরনার।
কোথায় থাকবেন ও খাবেন?
বড়তাকিয়া বাজারে থাকার দুটি আবাসিক হোটেল আছে। এছাড়া সীতাকুণ্ডে থাকার জন্য বেশ কিছু স্থানীয় হোটেল পাবেন। খাবারের জন্য স্থানীয় বাজারগুলোতে ভালো হোটেল আছে।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ