আবুল ফারজ আবদুর রহমান ইবনে জাওজি (রহ.) ছিলেন সমকালীন যুগের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর যুগে তিনি তাফসির, হাদিস ও ইতিহাস পর্যালোচনায় ছিলেন অনন্য। প্রতিটি বিষয়ে তিনি নিজস্ব জ্ঞানগর্ভ সমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন। ৫১০ হিজরিতে, ১১১৬ খ্রিস্টাব্দ বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন।
শৈশবে মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি পিতার স্নেহছায়া থেকে বঞ্চিত হন। মায়ের হাত ধরে ছোটবেলা থেকে কোরআন ও ইলমে তাজবিদের ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। সে যুগের বিখ্যাত মুহাদ্দিসদের কাছ থেকে হাদিস শ্রবণ এবং লিপিবদ্ধ করতে থাকেন। এ জন্য তিনি কঠিন পরিশ্রম করতে থাকেন। অন্য বাচ্চারা যে সময় খেলাধুলায় মত্ত থাকত, তিনি সে সময় কোনো হাদিসের দরসে বসে হাদিস শোনায় ব্যস্ত থাকতেন। অথবা নির্জন কোথাও বসে অধ্যয়নে নিমগ্ন থাকতেন।
ছোটবেলা থেকেই আল্লাহ তাআলা তাঁর মাঝে পড়াশোনার প্রতি তীব্র আগ্রহ দিয়েছিলেন। বিস্তৃত লাইব্রেরি থেকে কিতাব অধ্যয়ন করাই ছিল তাঁর নেশা। অধ্যয়নের ক্ষেত্রে তিনি নির্দিষ্ট কোনো শাস্ত্র নিয়ে অধ্যয়ন করতেন না; বরং যা-ই সামনে পেতেন তা-ই আদ্যোপান্ত শেষ করতেন। তিনি এক জায়গায় নিজের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে কিতাব অধ্যয়নে কখনোই আমার তৃষ্ণা মেটে না, যখনই আমি কোনো নতুন গ্রন্থের সন্ধান পাই, মনে হয় আমি গুপ্তধন পেয়েছি। আর এই আগ্রহ আমাকে দিন দিন আগে বাড়তে সাহায্য করেছে।
খোদাভীতি : জ্ঞান অন্বেষণের পাশাপাশি আল্লাহর ভয় ও ইবাদতের প্রতি বিশেষ ঝোঁক বা আগ্রহ আল্লাহ তাআলা তাঁকে দান করেছেন। তিনি প্রতি সপ্তাহে একবার কোরআন মাজিদ খতম করতেন। জীবনে কখনো সন্দেহযুক্ত খাবার আহার করেননি। সারা জীবন তাঁর এই অভ্যাস অব্যাহত ছিল। সারা রাত জেগে ইবাদত করাই তাঁর নেশায় পরিণত হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে বিশেষ গুণ ছিল নিজের মধ্যে পূর্ণতা অর্জন করা ও সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া। সে কারণে তিনি নানা প্রতিকূল-অনুকূল অবস্থায়ও তার এই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করেছেন।
ওয়াজ ও নসিহত : আল্লাহ তাআলা তাঁকে যত যোগ্যতা দিয়েছেন তার অন্যতম ওয়াজ-মাহফিলের যোগ্যতা। তাঁকে আল্লাহ তাআলা কথা বলার এমন জাদুময় মন্ত্র দান করেছেন যে মানুষ মুগ্ধতার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর কথা শুনত। তাঁর প্রতিটি সমাবেশেই লাখ লাখ মানুষ সমাগত হতো। তাঁর বক্তব্যের প্রভাব মানুষের অন্তরে ভীষণভাবে রেখাপাত করত। তাঁর কথায় বিমুগ্ধ হয়ে অনেক অমুসলিম তাঁর হাত ধরে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে।
লেখালেখি : তিনি এত বেশি পরিমাণে নিজ হাতে হাদিস লিপিবদ্ধ করেন যে মৃত্যুর সময় তিনি অসিয়ত করে যান যে তাঁর গোসলের পানি যেন ওই কাঠপেন্সিল দিয়ে গরম করা হয়, যা দ্বারা তিনি হাদিস লিপিবদ্ধ করেছেন। কারণ তিনি হাদিস লেখার জন্য এত পরিমাণে কাঠপেন্সিল ব্যবহার করেছেন, যা পানি গরম করার জন্য যথেষ্ট ছিল। পরবর্তী সময়ে এমন হয়েছে যে পানি গরম করার পর আরো কাঠপেন্সিল অবশিষ্ট ছিল। তাঁর লিখিত গ্রন্থের পরিমাণ তিন শর বেশি। মহান এই মনীষী ৫৯৭ হিজরি, ১২০১ খ্রিস্টাব্দে মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমান।
তথ্যঋণ : ওফায়াতুল আইয়ান, সাইদুল খাতির, তারিখে দাওয়াত ও আজিমত
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ