মাঠপর্যায়ে সরকারের দেওয়া জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর সংকট চলছে। উপজেলা ও মাঠপর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মজুত প্রায় শেষের দিকে। দেশের কোনো উপজেলায় ইমপ্লানন (একধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি) নেই, কোনো উপজেলায় ইনজেকশন নেই।
পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে কনডম শেষ হয়ে যাওয়ার পথে। জন্মনিরোধক বড়ির যে মজুত আছে, তা দিয়ে চলবে পাঁচ মাসের মতো। এই তথ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, সক্ষম দম্পতিদের ৩৭ শতাংশ এখন সরকারি খাত থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী পান। এনজিওদের কাছ থেকে পান ৩ শতাংশ। বাকি ৬০ শতাংশ পান বেসরকারি খাত থেকে।
হঠাৎ এক দিনে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী উধাও বা মজুত শূন্য হয়ে যায়নি। কোন সামগ্রীর মজুত কত আছে, তা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গেলেই দেখা যায়। নিয়মিত তা হালনাগাদ করা হয়। পরিস্থিতি দেখেও জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মজুত বাড়ানোর বা কেনার চেষ্টা করেনি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জবাবদিহির অনুপস্থিতির কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি সেবার এই অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে দেশের জনসংখ্যার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে চেষ্টা করেও দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য আছে। স্বাধীনতার সময়ে একজন প্রজননক্ষম নারী গড়ে ছয়টির বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন। এখন গড়ে দুটি সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন একজন মা। এটা সম্ভব হয়েছে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে। ১৯৭৫ সালে ৮ শতাংশ দম্পতি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। ২০২২ সালে এই হার ছিল ৬৪ শতাংশ। সরকার পরিবার পরিকল্পনা সেবা বৃদ্ধির কথা বলছে, অন্যদিকে মাঠপর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর সংকট চলছে।
মাঠ পরিস্থিতি
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মীরা বিনা মূল্যে সক্ষম দম্পতির কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী পৌঁছে দেন। সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেও এসব সামগ্রী সংগ্রহ করা যায়। এর মধ্যে আছে ইমপ্লানন, কনডম, খাওয়ার বড়ি, জরুরি জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি (ইসিপি), আইইউডি, ইনজেকশন ও ইমপ্ল্যান্ট।
ওয়েবসাইটে পাঁচটি রঙের মাধ্যমে নির্দেশ করা হয়েছে কোথায় জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর কী অবস্থা। মজুত শূন্য হলে লাল রং, মজুত শূন্য হওয়ার ঝুঁকি থাকলে তামাটে রং, প্রয়োজনের চেয়ে মজুত কম থাকলে হলুদ রং, মজুত থাকলে সবুজ রং এবং অতিরিক্ত মজুত থাকলে নীল রং ব্যবহার করা হয়েছে।
সরকারের ওয়েবসাইটে (সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট পোর্টাল) গিয়ে ইমপ্লাননের ব্যাপারে জানতে চাইলে দেখা যায়, পুরো বাংলাদেশের মানচিত্রের রং লাল। অর্থাৎ দেশের ৪৯৪টি উপজেলার কোনোটাতে ইমপ্লানন নেই। ইমপ্লানন এক কাঠির বা দণ্ডের দীর্ঘস্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। এগুলো বিবাহিত নারীদের বাহুর নিচের অংশে ত্বকের নিচে স্থাপন করা হয়। দুই দণ্ডের ইমপ্ল্যান্ট নেই ৪৮ উপজেলায়।
স্বাধীনতার সময়ে একজন প্রজননক্ষম নারী গড়ে ছয়টির বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন। এখন গড়ে দুটি সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন একজন মা। এটা সম্ভব হয়েছে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলার পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক জানিয়েছেন, তাঁর জেলায় একটিও ইনজেকশন নেই। সর্বশেষ ইনজেকশন ব্যবহৃত হয়েছে ৩১ জানুয়ারি। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৩১ জানুয়ারি সারা দেশে ইনজেকশন শেষ হয়েছে। ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ২৯৮টি উপজেলায় ইনজেকশন নেই, ১৫৫টি উপজেলায় ইনজেকশন শেষ হওয়ার পথে। এ তথ্য অবশ্য ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের।
জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মধ্যে পুরুষের জন্য আছে কনডম। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের তথ্য দিয়ে ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ৩৪৯টি উপজেলায় একটিও কনডম নেই।
বড়ি আছে ৫ মাসের
ওয়েবসাইটে দেখা যায়, মুখে খাওয়ার বড়ির মজুত শেষ হয়নি। তবে ৩৮টি উপজেলায় এই সামগ্রী নেই। মুখে খাওয়ার বড়ি ‘আপন’ নেই ৬৭টি উপজেলায় (এই বিশেষ বড়ি শুধু সন্তান জন্ম দেওয়ার পর ছয় মাস পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়)। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, বড়ির যে মজুত আছে, তাতে চলবে মাত্র পাঁচ মাস। পাঁচ মাস পরে মুখে খাওয়ার বড়িও থাকবে না কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে বা মাঠপর্যায়ের কর্মীদের হাতে।
অধিদপ্তরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, বড়ি কেনার কোনো প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। গত তিন দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী কেনার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার প্রায় এক বছর পর সেই সামগ্রী অধিদপ্তর হাতে পায়। বিশেষ ব্যবস্থা বা উদ্যোগ না নিলে বড়ির মজুতও শূন্য হয়ে পড়বে।
জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মধ্যে পুরুষের জন্য আছে কনডম। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের তথ্য দিয়ে ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ৩৪৯টি উপজেলায় একটিও কনডম নেই।
কথা বলতে চান না কেউ
জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মজুতের তথ্য ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ওয়েবসাইটে পাওয়া গেছে। এরপরের এক মাসের অর্থাৎ গত জানুয়ারি মাসের তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে একাধিক জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক ও উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জানুয়ারি মাসে কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী তাঁরা পাননি। চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলার এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তিনি কক্সবাজার জেলা থেকে সামগ্রী এনে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন।
জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মজুত পরিস্থিতি ও মজুত শেষ হওয়ার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া জানার জন্য পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানুর বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্ত তিনি কোন মন্তব্য করেননি।
শূন্য মজুতে ক্ষতি কী
সরকারি প্রতিষ্ঠানে বা সেবাকর্মীদের কাছ থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী সংগ্রহ না করেও অনেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তা সংগ্রহ করেন। ওষুধের দোকানে এবং চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারে এসব সামগ্রী পাওয়া যায়। মুদির দোকানেও কনডম বিক্রি হয়।
জনসংখ্যাবিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী সংগ্রহ করেন সাধারণত দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। এখন তাঁরা প্রয়োজনের সময় এসব সামগ্রী হাতের কাছে পাবেন না। প্রয়োজনের সময় তাঁরা দোকান থেকে কিনবেন, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ কারণে দরিদ্র পরিবারগুলোতে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ঝুঁকি বাড়বে।
অন্য আরেকটি সমস্যা হতে পারে। জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী সংগ্রহের সময় মানুষ সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আরও কিছু স্বাস্থ্যসেবা বা পরামর্শ নেন। জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী না নিতে এলে তাঁরা অন্য সেবা থেকেও বাদ পড়বেন।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী সরবরাহে ঘাটতি থাকলে দরিদ্র মানুষ বেসরকারি খাতের দিকে ঝুঁকতে পারে। এতে পদ্ধতি ব্যবহার কমে যেতে পারে। এ ফলে অপূর্ণ চাহিদার হার বাড়তে পারে। বর্তমানে অপূর্ণ চাহিদার হার ১০ শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে এই হার শূন্য করার প্রতিশ্রুতি আছে। সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন না হলে প্রতিশ্রুতি পূরণ কঠিন হবে। অন্যদিকে অপূর্ণ চাহিদা বাড়লে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, গর্ভপাত, মাতৃমৃত্যু—সবই বাড়বে। সুতরাং দ্রুত জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মজুত বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার।’
বাংলা৭১নিউজ/সূত্র: সহযোগি একটি দৈনিক