জাল রেকর্ডপত্র তৈরি করে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হস্তান্তর, অনুমতি ও নামজারি করে গুলশান-২ আবাসিক এলাকার ১০৪ নম্বর সড়কের ২৭/বি নম্বরে ২৭ কাঠা সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের ঘটনায় অবশেষে আসামি হয়েছেন খুলনা-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাবেক সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট আব্দুস সালাম মুর্শেদী।
একইসঙ্গে আসামির তালিকায় যোগ হয়েছেন ওই সম্পত্তি দখল করা অপর অংশীদার ইফফাত হক ও তার স্বামী মোহাম্মদ আব্দুল মঈন। এ দম্পতি ২৭ কাঠার মধ্যে ১২ কাঠা দখল করেছিলেন। বাকি ১৫ কাঠা দখল করে বাড়ি নির্মাণ করেছিল সালাম মুর্শেদী।
তদন্তে আগত হিসেবে চার্জশিটে (তদন্ত প্রতিবেদন) ইফফাত হক ও তার স্বামী মোহাম্মদ আব্দুল মঈন আসামি হয়েছেন। এ দম্পতি মামলায় আসামি ছিলেন না। মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) ঢাকা মহানগর বিশেষ জজ আদালতে এ সংক্রান্ত মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। দুদকের উপপরিচালক মো. আনোয়ারুল হক ও উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মামলার চার্জশিটভুক্ত ১৩ আসামি হলেন– রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন খাদেম ও প্রকৌশলী এম আজিজুল হক, সাবেক সদস্য (এস্টেট) লে. কর্নেল (অব.) এম নুরুল হক, সাবেক পরিচালক আবদুর রহমান ভূঁঞা, সাবেক উপপরিচালক (এস্টেট) মো. আজহারুল ইসলাম ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক মো. হাবিব উল্লাহ।
অন্যদিকে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সহকারী সচিব আবদুস সোবহান, সাবেক শাখা সহকারী মো. মাহবুবুল হক এবং কক্সবাজারের রামুর বাসিন্দা মীর মোহাম্মদ হাসান ও তার ভাই মীর মো. নুরুল আফছারকে আসামি করা হয়েছে।
চার্জশিটে নতুন করে সালাম মুর্শেদীসহ জমির দখলদার হিসেবে তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। আর চার্জশিটে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে রাজউকের সহকারী পরিচালক (নিরীক্ষা ও বাজেট) শাহ মো. সদরুল আলমকে। আওয়ামী সরকারের পতনের পর হত্যা মামলায় গত ১ অক্টোবর সালাম মুর্শেদীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
চার্জশিটসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, জাল রেকর্ডপত্র তৈরি করে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হস্তান্তর, অনুমতি ও নামজারি অনুমোদনের মাধ্যমেই রাজধানীর গুলশান-২ এর ১০৪ নম্বর সড়কের ২৭/বি নম্বর বাড়িটির মালিক হন খুলনা-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাবেক সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট সালাম মুর্শেদী।
সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক দুই চেয়ারম্যানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক। দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সংস্থাটির উপপরিচালক ইয়াছির আরাফাত বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
যদিও অজ্ঞাত কারণে বাড়ির মালিক হয়েও আসামি হননি সালাম মুর্শেদী। তবে মামলা দায়ের করার দিনই বাড়িটি পুনরুদ্ধারের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দিয়েছিল দুদক।
এদিকে চার্জশিটে বলা হয়েছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ও সরকারি কর্মচারী হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এবং অসৎ উদ্দেশ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত গেজেটে খ তালিকাভুক্ত গুলশান আবাসিক এলাকার সিইএন (ডি) ২৭নং, হোল্ডিং নং-২৯, রোড নং-১০৪ প্লটটি পরিত্যক্ত ২৭ কাঠা সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও অবমুক্তকরণ ছাড়াই জাল জালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যা রেকর্ডপত্র তৈরি করেন।
যা পরে হস্তান্তর অনুমতি ও নামজারি অনুমোদন করার মাধ্যমে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের সুযোগ তৈরি করে। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়।
নথি জালিয়াতির মাধ্যমে সালাম মুর্শেদীকে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়— এমন অভিযোগ তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ২০২২ সালের ১১ আগস্ট দুদকে আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। দুদক আবেদন আমলে না নেওয়ায় একই বছরের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্টে রিট করেন তিনি।
রিট আবেদনে বলা হয়, রাজধানীর গুলশান-২-এর ১০৪ নম্বর সড়কের ২৭/বি নম্বর বাড়িটি ১৯৮৬ সালের অতিরিক্ত গেজেটে ‘খ’ তালিকায় পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত। কিন্তু আব্দুস সালাম মুর্শেদী সেটি দখল করে বসবাস করছেন।
২০১৫ ও ২০১৬ সালে দেওয়া চিঠিতে পরিত্যক্ত বাড়ির তালিকা থেকে বাড়িটি অবমুক্ত না হওয়ার পরও আব্দুস সালাম মুর্শেদী কীভাবে বাড়িটি দখল করে আছেন, রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে কয়েক দফা ব্যাখ্যাও চেয়েছিল গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। কিন্তু রাজউক চেয়ারম্যান সে ব্যাখ্যা দিতে অনীহা প্রকাশ করেন।
২০২২ সালের ১ নভেম্বর এ সংক্রান্ত রিটের শুনানিতে ১০ দিনের মধ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, রাজউক চেয়ারম্যান এবং আব্দুস সালাম মুর্শেদীকে হলফনামা আকারে নথি দাখিল করতে বলেন হাইকোর্ট।
একইসঙ্গে রুলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির ‘খ’ তালিকাভুক্ত বাড়িটি বেআইনিভাবে দখল করার অভিযোগে আব্দুস সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব, রাজউক চেয়ারম্যান, দুদক চেয়ারম্যান, ঢাকার জেলা প্রশাসক ও আব্দুস সালাম মুর্শেদীকে রুলের জবাব দিতে বলেন হাইকোর্ট। এরপর দুদক অভিযোগটি আমলে নেয়। পরে উপ-পরিচালক ইয়াছির আরাফাত ও জেসমিন আক্তারের সমন্বয়ে অনুসন্ধানী টিম গঠিত হয়।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ