বাংলা৭১নিউজ,ঢাকা: সমাপ্ত বছরে দেশের জ্বালানি খাতের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ইয়ার্ড থেকে ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা চুরি। এ ঘটনার পরপরই জ্বালানি বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পৃথক দুটি কমিটি গঠন করে। কিন্তু ছয় মাসেও কোনো কমিটিই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
গত বছরের জুলাইয়ে বড়পুকুরিয়ার কয়লা চুরির ঘটনায় জ্বালানি সংকটে বন্ধ হয়ে যায় দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলায় দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন। পাশের কয়লা খনি থেকে উৎপাদিত কয়লা দিয়েই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জ্বালানি চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু কয়লা সংকটে প্রায় দেড় মাস বন্ধ থাকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকেও। প্রাথমিকভাবে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বরখাস্তসহ কয়েকজনকে কোম্পানি থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করে পেট্রোবাংলা।
আলোচিত এ ঘটনার পরপরই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করে দুদক। এজন্য গত বছরের জুলাইয়ে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তের অংশ হিসেবে এ পর্যন্ত অন্তত ৪০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে দুদক। যদিও দুর্নীতির মূল হোতাদের চিহ্নিত করার কাজে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
যদিও গত বছরের ৩০ আগস্ট অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা গায়েবের ঘটনা দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অবহেলা বলে জানানো হয়েছিল। কমিটির পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, কয়লা গায়েবের ঘটনা তদন্তসাপেক্ষ হলেও কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব অবহেলার দায় এড়াতে পারেন না। তাদের অবহেলার কারণেই কয়লা মজুদের বিষয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য এসেছে।
একই সঙ্গে দায়িত্বে অবহেলার জন্য প্রচলিত আইনে কর্মকর্তাদের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন বলেও অভিমত দিয়েছিল সংসদীয় কমিটি। এরপর অভিযোগের সপক্ষে আরো কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা থাকলেও সে বিষয়ে কোনো অগ্রগতির কথা জানাতে পারেননি দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিস্টেম লসের প্রশ্ন ওঠায় কয়লা উধাওয়ের ঘটনাটি আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত কার্যক্রম শেষ হতে সময় লাগবে।
দুদকের উপপরিচালক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শামসুল আলম বলেন, বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।
কয়লা উধাওয়ের ঘটনা বিস্তারিত তদন্তে দুদকের পাশাপাশি জ্বালানি বিভাগ থেকেও একটি কমিটি গঠন করা হয়। গত ছয় মাসেও প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারেনি এ কমিটি।
এ বিষয়ে জানতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং জ্বালানি সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমকে ফোন করা হলেও পাওয়া যায়নি। জ্বালানি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পারভীন আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তদন্ত শেষ হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের কাছে রয়েছে।
ওই ঘটনার পর পরই পেট্রোবাংলার প্রাথমিক তদন্তে ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা গায়েবের তথ্য উঠে আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৪ জুলাই খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ১৯ জনকে আসামি করে দুর্নীতি দমন আইনে মামলা করেন কোম্পানির ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আনিছুর রহমান।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, খনি উন্নয়নের সময় (২০০১) থেকে ১৯ জুলাই ২০১৮ পর্যন্ত মোট ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার ৪২ দশমিক ৩৩ টন কয়লা উৎপাদন করা হয়েছে। উৎপাদিত কয়লা থেকে পার্শ্ববর্তী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে ৬৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৯ দশমিক ২৯ টন কয়লা সরবরাহ, বেসরকারি ক্রেতাদের কাছে ডিওর মাধ্যমে ৩৩ লাখ ১৯ হাজার ২৮০ দশমিক ৩৭ টন কয়লা বিক্রি এবং কয়লা খনির বয়লারে ১২ হাজার ৮৮ দশমিক ২৭ টন কয়লা ব্যবহার করা হয়।
কয়লার উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার হিসাব করলে ১৯ জুলাই কোল ইয়ার্ডে রেকর্ডভিত্তিক কয়লার মজুদ দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬৪৪ দশমিক ৪০ টন। কিন্তু বাস্তবে মজুদ ছিল প্রায় তিন হাজার টন কয়লা। অর্থাৎ ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ দশমিক ৪০ টন কয়লা ঘাটতি রয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২৩০ কোটি টাকা।
অভিযোগে বলা হয়, এ ঘটনায় চারজনের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বাকি ১৫ জন আসামি অনেক আগে থেকেই তত্কালীন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে সংঘটিত কয়লা চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে অনুমিত হয়।
এ ঘটনায় তত্কালীন এমডি হাবিব উদ্দিন আহমেদ, কোম্পানি সচিব ও মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আবুল কাশেম প্রধানিয়া, মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) নূর-উজ-জামান চৌধুরী ও উপমহাব্যবস্থাপক (স্টোর) একেএম খালেদুল ইসলামসহ খনির ব্যবস্থাপনায় জড়িত অন্যরা কয়লা চুরির ঘটনায় জড়িত বলেও এজাহারে অভিযোগ করা হয়। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর নূর-উজ-জামান ও খালেদকে সাময়িক বরখাস্ত করে পেট্রোবাংলা। হাবিব উদ্দিনকে ঢাকায় সরিয়ে আনার পাশাপাশি কাশেম প্রধানিয়াকে সিরাজগঞ্জে বদলি করা হয়।
কয়লা গায়েব মামলার তদন্তে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) সাবেক ছয় এমডিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তারা সবাই নিজেদের দায় এড়িয়ে গেছেন। তাদের প্রায় প্রত্যেকেই দাবি করছেন, স্বল্প সময় দায়িত্ব পালন করেছেন তারা, এ সময়ের মধ্যে কয়লা লোপাটের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জ্বালানি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, চুরি যাওয়া কয়লা সিস্টেম লস হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চলছে। কয়লা চুরির সঙ্গে জড়িত অসাধু কর্মকর্তারা নানা তদবির করছেন। এ কারণে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশে কালক্ষেপণ হচ্ছে।
বাংলা৭১নিউজ/সংগৃহিত:বণিকবার্তা/এমআর