করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে ২০২১ সালের অমর একুশে বইমেলা ঘোষিত সময়ের দুদিন আগেই শেষ হয়ে যায়। একদিকে করোনা অন্যদিকে লকডাউনে মানুষ ছিল ঘরবন্দি। যে কারণে বইপ্রেমীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেলায় আসেননি বলে বিক্রেতারা ছিলেন হতাশ। এমন প্রাণহীন বইমেলা আগে কখনো দেখেননি বলেও মন্তব্য করেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।
তবে আশার কথা হচ্ছে, এবছর অমর একুশে বইমেলা যথাসময়ই শুরুর প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলা একাডেমি। এরই মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলার অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি বইমেলা উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই তো বইমেলা নিয়ে অনেক প্রত্যাশা কবি-লেখকদের। আজ কবি-লেখকরা জানান তাদের প্রত্যাশার কথা—
কবি ও গবেষক ড. তপন বাগচী বলেন, ‘করোনা ও ওমিক্রন যেভাবে ধেয়ে আসছে, তাতে বইমেলা হবে কি না, তা নিয়েই সংশয় আছে। তবু বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা, বাঙালির এক সাংস্কৃতিক উৎসব। বইমেলাকে কেন্দ্র করে নতুন বই প্রকাশের সুযোগ হয়। নতুন লেখক তার অস্তিত্ব ঘোষণা করেন। নতুন ক্রেতাও তৈরি হয় এই মেলাকে কেন্দ্র করে। বইমেলার পরিপাট্য আগের মতো থাকবে বলে বিশ্বাস করি।
এবারের বইমেলায় স্বাধীনতার ৫০ বছর, জাতির পিতার জন্মের ১০০ বছর এবং ভাষা-আন্দোলনের ৭০ বছর। তাই অন্য যে কোনো বছরের তুলনায় এই মেলা ভিন্ন চেতনা জাগ্রত করবে। প্রকাশকগণ সেই বিবেচনা রেখে তাদের বই প্রকাশ করবেন বলে প্রত্যাশা করি। আমি দেখতে চাই, বইমেলা করোনামুক্ত হোক, পাঠক-বিক্রেতা-প্রকাশক-লেখকের সত্যিকার মিলনমেলা হোক।’
কবি ও কথাশিল্পী আবু আফজাল সালেহ বলেন, ‘পাঠকের সংখ্যা বেড়ে যাক। কমপক্ষে ৫০ টাকার টিকিট বাধ্যতামূলক করা হোক। সেই কুপন দেখিয়ে প্রত্যেকে কমপক্ষে একটি বই কিনতে পারবেন। এ ছাড়া লিটলম্যাগ চত্বরের কাছাকাছি অনুবাদ সাহিত্য বা বিশ্বসাহিত্যের জন্য একটি আলাদা স্থান রাখলে প্রীত হবো। বইমেলার মধ্যভাগ থেকে যদি ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, জারি, সারি বেজে চলে।
তাহলে সুখানুভূতি হবে। আরও পুলকিত হবো, যখন দেখবো স্টলে স্টলে লেখকের জন্য কমপক্ষে একটি করে হলেও চেয়ার সংরক্ষিত আছে। শেষে বলি, বইমেলাটাই আসল। প্রচারের পাশাপাশি বইয়ের কেনাকাটা বেশি হলেই মেলা বাঁচবে। এতে লেখকের সঙ্গে প্রকাশক, ছাপাখানা, রিকশাচালক বাঁচবে; একটি জাতি বাঁচবে, মেরুদণ্ডটি সোজা হবে। প্রতিবছর এমন বইমেলাই ঘুরে ঘুরে আসুক।’
জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও নির্মাতা সাদাত হোসাইন বলেন, ‘শঙ্কিত লাগছে গত বইমেলার কথা ভেবে। ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতার কারণেই বারবার প্রার্থনা করছিলাম, এবারের বইমেলা যেন স্বাভাবিক হয়। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, তাতে আবারো ভীত বোধ করছি। এটি আসলে একধরনের উভয় সংকট পরিস্থিতি। লেখক-প্রকাশকরা হয়তো তাদের গত বছরের ভয়ানক আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবারের বইমেলা চাইছেন।
পাঠকরাও হয়তো প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে একটি প্রাণবন্ত ঝলমলে বইমেলার অপেক্ষায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, করোনার নতুন ধরনের সংক্রমণের যে অবস্থা বিশ্বব্যাপী, তাতে এ মুহূর্তে বইমেলা হলেও সার্বিক পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে—সেটি ভেবেও ভীত লাগছে। এ অবস্থায় বেশি কিছু আশা করার আসলে অবকাশ নেই। তবে মনে মনে প্রার্থনা করছি, কোনো একটা মিরাকল যেন ঘটে। আর পরিস্থিতি যেন হঠাৎ স্বাভাবিক হয়ে যায়।’
কবি ও কথাশিল্পী ফখরুল হাসান বলেন, ‘বইমেলার কিছু কিছু বিষয় আমাকে আহত করে। যেমন বইমেলায় ‘লেখক বলছি’ মঞ্চ আছে। আমার প্রশ্ন এ মঞ্চের কাজ কী? মঞ্চের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে মনে হচ্ছে—মঞ্চ একটি সিন্ডিকেট। এ থেকে তৈরি হচ্ছে বৈষম্য। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
তাই এ মঞ্চ বাতিলের পক্ষে আমি। আমরা দেখছি, প্রতিবছর বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু মানের দিক দিয়ে তা কতটা গ্রহণযোগ্য! বাংলা একাডেমির উচিত বিষয়টি নিয়ে কাজ করা। মানহীন বইয়ের প্রচার, প্রসার ও লেখকদের দৌরাত্ম্যের কারণে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই পাঠকের কাছে পৌঁছায় না।
তাছাড়া বইমেলাকে কেন্দ্র করে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট, খাবারের দোকান, স্মোকিং জোন রাখা উচিত। সর্বোপরি লেখক-পাঠকের জন্য মনোরম একটি পরিবেশ তৈরি করা বাংলা একাডেমির দায়িত্ব।’
লেখক ও ছড়াকার মিজানুর রহমান মিথুন বলেন, ‘সুশৃঙ্খল স্টল বিন্যাস, মানে স্টল নম্বর এমনভাবে বিন্যস্ত করা হোক; যাতে প্রতিটি স্টল বা প্যাভিলিয়ন খুঁজে পেতে সহজ হয়। বইমেলায় আগত ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা মাস্ক পরাসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন, সেটা সুনিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে লিটলম্যাগ কর্নারটি আরও সুশোভিত করার দাবি জানাচ্ছি। সব শেষে বইমেলার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করছি।’
লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার বলেন, ‘এবারের বইমেলা নিয়ে লেখক ও পাঠকের বাড়তি আগ্রহ রয়েছে। বিশেষ করে গত বইমেলা স্বশরীরে হলেও লকডাউন পরিস্থিতি উৎসবমুখর পরিবেশে ভাটা তৈরি করে। ফেব্রুয়ারিতে শুরু হতে যাওয়া মেলায় লেখক-প্রকাশক-পাঠকের প্রাণের টানে উন্মাদনা সৃষ্টি করছে।
বাংলা একাডেমি কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মানুষের পদচারণা উৎসবমুখর আবহ নিয়ে আসবে। মেলায় কিশোর-যুবা-বৃদ্ধদের মেলবন্ধনে প্রাণচাঞ্চল্য বিরাজ করবে—সে প্রত্যাশা রইলো। আশা করি প্রাণের বইমেলা তার আপন মহিমায় পাঠকের তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম হবে।’
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ