শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নির্দেশনা দেওয়ার পর বৃহস্পতিবার দেশের শেয়ারবাজরে বড় ধরনের দরপতন হয়েছে। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেনে অংশ নেওয়া ৬৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের স্থান হয়েছে পতনের তালিকায়। সেই সঙ্গে কমেছে লেনদেনের পরিমাণ।
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে নির্দেশনা দিয়েছে তা বাজারের জন্য সম্পূর্ণ নেতিবাচক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনার ফলে শেয়ারবাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সংকুচিত হবে।
তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের দাবি ছিল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এক্সপোজার বা বিনিয়োগ বাজারমূল্যের পরিবর্তে ক্রয়মূল্যে গণনা করা। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনাতেও বিনিয়োগ বাজারমূল্যে গণনার কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে বন্ডের মতো ডেভ সিকিউরিটিজ, ডিবেঞ্চার, মিউচুয়াল ফান্ডকে বিনিয়োগ গণনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজারে।
বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ঘুরে দেখা গেছে, বুধবারের মতো বৃহস্পতিবারও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আলোচনায় ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা নির্দেশনা। নির্দেশনাটি শেয়ারবাাজরের জন্য ভালো না কী মন্দ তা নিয়েই আলোচনা করছেন বিনিয়োগকারীরা।
তবে লেনদেনের সময় এক ঘণ্টা না গড়াতেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনাটি শেয়ারবাজারের জন্য নেতিবাচক। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির এক ধরনের চাপ বেড়ে যায়। যার ফলে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
ফলে লেনদেনের শুরুতে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান দাম বাড়ার তালিকায় নাম লেখালেও লেনদেন শেষে পতনের তালিকায় স্থান হয়েছে সিংহভাগের। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার মাধ্যমে দিনের লেনদেন শুরু হওয়ায় প্রথম দুই মিনিটেই ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ১০ পয়েন্ট বেড়ে যায়।
কিন্তু লেনদেনের সময় ১০ মিনিট না গড়াতেই বদলে যেতে থাকে চিত্র। দাম বাড়ার তালিকা থেকে একের পর এক প্রতিষ্ঠান নাম লেখাতে থাকে পতনের তালিকায়। লেনদেনের সময় গাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে পতনের মাত্রা।
ফলে দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইতে মাত্র ৭৫টি প্রতিষ্ঠান দাম বাড়ার তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২৫৭টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের। আর ৪৫টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। শতাংশের হিসাবে দাম ৬৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের দরপতন হয়েছে। বিপরীতে দাম বেড়েছে মাত্র ২০ শতাংশের।
বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমায় দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৫২ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৯৯১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক আগের দিনের তুলনায় ১৩ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৫০৮ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আর বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক ২৪ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ৫৭৩ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
অবশ্য এর মধ্যেই দিনের শেয়ারের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে দাপট দেখিয়েছে সাত প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে জিকিউ বলপেনের শেয়ার দাম বাড়ার সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করেছে। এছাড়া ইস্টার্ণ কেবলস, স্টাইল ক্রাফট, অ্যাপেক্স ফুডস, জেএমআই সিরিঞ্জ, এমবি ফার্মা এবং ওয়াটা কেমিক্যালের শেয়ার দাম বেড়ে প্রায় সর্বোচ্চ সীমা কাছাকাছি চলে যায়।
বড় দরপতনের দিনে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৪ কোটি ৯৯ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয় ১ হাজার ২১৩ কোটি ৬৪ টাকা। সে হিসাবে লেনদেন কমেছে ২০৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
ডিএসইতে টাকার অংকে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে বেক্সিমকোর শেয়ার। কোম্পানিটির ১০৪ কোটি ৯১ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ওরিয়ন ফার্মার ৬৪ কোটি ৯০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। ৫৪ কোটি ৩২ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন।
এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- ফরচুন সুজ, ইয়াকিন পলিমার, সোনালী পেপার, রহিমা ফুড, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো, জেএমআই সিরিঞ্জ এবং স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস।
অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ১৭৪ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৩৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নেওয়া ৩১৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬০টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২১৯টির এবং ৩৭টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
শেয়ারবাজারের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাটি শেয়ারবাজারের জন্য সম্পূর্ণ নেতিবাচক। বন্ড হলো একটা ডেভ ইনুস্টুমেন্ট, এটা ইক্যুইটি না।
এটা এক্সপোজারে কীভাবে আসে? দ্বিতীয়ত মিউচ্যুয়াল ফান্ড কোনো শেয়ার না, এটা একটি ইউনিট। এটা কীভাবে এক্সপোজারে আসে। আবার এক্সপোজার গণনা আমরা বারবার বলেছি ক্রয়মূল্যে বিবেচনা করার জন্য, কিন্তু ওনারা বাজারমূল্যই ধরে রেখেছেন। এই নির্দেশনাটা সম্পূর্ণ নেতিবাচক।
তিনি বলেন, নির্দেশনায় আর একটা কথা বলা হয়েছে সাবসিডারি কোম্পানিকে যে ইক্যুইটি দেওয়া হয়েছে তা ওই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারবাজার বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে না। এটা নতুন কিছু না। আতিউর রহমান গভর্নর থাকা অবস্থাতেই এটার সমাধান হয়েছে।
তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের কোন কোন উপাদান শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে, সে বিষয় সুস্পষ্ট করে গত মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) একটি নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এতে বলা হয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩-এর ১৬ ধারায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অন্যান্য কোম্পানির শেয়ার ধারণের সর্বোচ্চ সীমার বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। তবে বিনিয়োগের কোন কোন উপাদান আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারবাজার বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় তা স্পষ্টীকরণের প্রয়োজনীয়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ধারণ করা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সকল প্রকার শেয়ার, ডিবেঞ্চার, করপোরেট বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিট এবং শেয়ারবাজারের অন্যান্য নিদর্শনপত্রের বাজারমূল্য বিবেচনায় নেওয়া হবে। তবে নিজস্ব সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বা কোম্পানিসমূহকে দেওয়া ইকুয়িটি, দীর্ঘমেয়াদি ইকুয়িটি বিনিয়োগ/ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি (বিডি) ও স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর শেয়ার ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারবাজার বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে না।
এতে আরও বলা হয়, শেয়ারবাজারে কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়োজিত অপর কোনো কোম্পানি বা কোম্পানিগুলোর অথবা কোনো স্টক ডিলারকে প্রদত্ত ঋণের স্থিতি ও তাদের সঙ্গে রক্ষিত তহবিলের স্থিতি (প্লেসমেন্ট বা অন্য যে নামেই অভিহিত করা হউক না কেন) বিনিয়োগসীমার বাইরে থাকবে।
বাংলা৭১নিউজ/এআরকে