বাংলা৭১নিউজ, মো.কামাল হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি: চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলা বরেন্দ্র অঞ্চলের কালের স্বাক্ষী ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের সূতিকাগার, বীরাঙ্গনা ইলামিত্রের স্মৃতিধন্য “বাথানবাড়ি”গুলো। প্রচন্ড খরতাপে এককালের রুক্ষ-শুস্ক মরুময় উঁচুনিচু বরেন্দ্রভূমি চাষাবাদের মৌসুমী আশ্রয়কেন্দ্র ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের “বাথানবাড়ি”তে বর্গা চাষিরা বর্ষা মৌসুমে তিন-চার মাস ধান চাষের প্রয়োজনে উলু খড়ের ছাউনী দিয়ে ছোট্ট ঘর মেরামত করে বাস করত।
বরেন্দ্র অঞ্চলে ধান কাটামাড়াই শেষ হলে বর্গা চাষিরা জমি মালিককে তাদের পাওনা(হিস্যা)র ফসল জমি মালিকদের দিয়ে বাকি ৮ মাস চারণভূমি হিসেবে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকত ওই বাথানবাড়িগুলি। মাঠে চরে বেড়ানো গরু-মহিষ ওই বাথানবাড়ির চালের খড় খেয়ে ফেলত। পরিত্যক্ত বাথানবাড়িগুলি ঝড় ও বর্ষাকালে বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেত। গ্রীস্মকালের খাঁ-খাঁ রোদে রাখালরা বিশ্রাম নিত ওই বাথানবাড়ি গুলোতে। আবার আবাদ মৌসুমে বাথানবাড়ির ঘরগুলি মেরামত করা হত। মুখরিত হয়ে উঠত বরেন্দ্র অঞ্চলের বাথানবাড়িগুলি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার ওই বাথানবাড়িতেই সাঁওতাল বিদ্রোহ বা ভূমি মালিকদের সাথে বর্গাচাষিদের ন্যায্য পাওনা নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ “তে-ভাগা আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়েছিল।
তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের নাচোল থানার কেন্দুয়া-ঘাষুড়া পরগনার জমিদার শ্রী রমেণ মিত্রের স্ত্রী শ্রীমতি ইলামিত্র তাঁর স্বামীর জমিদারিতে অমুসলিম (সাঁওতাল) বর্গাচাষিদের জন্য তিন ভাগের এক ভাগ জমির মালিক, একভাগ বর্গা চাষির ও একভাগ বর্গাচাষির উৎপাদন খরচ হিসেবে বর্গাদারের পাওনা-ঐতিহাসিক “তে-ভাগা” সূত্র বাস্তবায়ন করেন। জমিতে উৎপাদিত ফসলে বর্গাচাষীদের তে-ভাগা দাবি অনেক ভূমি মালিক মেনে নিতে পারেননি। ফলে জমি মালিকদের সাথে বর্গাচাষি (সাঁওতালদের) সাথে মনোস্তাত্বিক বিরোধ বাধে।
এক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর, সিলেট, পাবত্য চট্টগ্রাম, নওগাঁ জেলার জয়পুরহাট ও তৎকালিন মালদা জেলার (চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহুকমা)র নাচোলে সাঁতাল বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। একসময় ভূমি মালিকদের পক্ষ নিয়ে (তে-ভাগা আন্দোলনে) সাঁওতালদের উস্কানীদাতা হিসেবে নাচোলের রানীমাতা খ্যাত ইলামিত্র গোপনে ভারতে চলে যাবার সময় গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর এলাকায় ছৈওয়ালা গরুর গাড়ি থেকে আটক করে পাকিস্তান পুলিশ। আটক ইলামিত্রকে থানায় নিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালায় তৎকালিন পাকিস্তান পুলিশ বাহিনী।
নাচোলের রানীমাতা খ্যাত ইলামিত্রকে আটকের পূর্বেই পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিধু, কানহুসহ অনেক সাঁওতাল বীর। তাই সাঁওতালদের আন্দোলন সংগ্রামের সাথে মিশে আছে বরেন্দ্র অঞ্চলের বীরাঙ্গনা ইলামিত্রের স্মৃতিধন্য ঐতিহাসিক “বাথানবাড়ি”গুলি। লোক সাহিত্যিক ও গবেষক ড. মাজহারুল ইসলাম তরুর মতে এসকল ঐতিহাসিক নিদর্শন বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় বরেন্দ্র অঞ্চলের রাস্তাঘাটের উন্নয়নসহ কালের বিবর্তনে হারানো প্রায় বাথানবাড়ি গুলোকে সংরক্ষণ করে অঞ্চল ভেদে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা উচিত।
বাংলা৭১নিউজ/জেএস