বাংলা৭১নিউজ,ঢাকা: ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৫ শতাংশ কমে আসার পাশাপাশি একই সময়কালে ছাড়প্রাপ্ত রোগীর হারও বেড়েছে প্রায় ৩৬ ভাগ। এছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত মোট রোগীর প্রায় ৭৫ শতাংশই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত আরো ছয় জন রোগী গতকাল শুক্রবার মারা গেছেন। এদিকে ভারী বৃষ্টি হলে ঝুঁকি কম হলেও থেমে থেমে বৃষ্টিতে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়ে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। অন্যদিকে ডেঙ্গু রোগীরা ঢাকা ছাড়লে এ রোগের প্রকোপ বাড়বে বলে অনেকে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। এডিস মশা না কামড়ালে ডেঙ্গু জ্বর হবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত সারাদেশে ২ হাজার ২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তার আগের ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ২ হাজার ৩২৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়। তারও আগের ২৪ ঘণ্টায় এই সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪২৮ জন। বুধবারের চেয়ে বৃহস্পতিবার হাসপাতালে ডেঙ্গু ভর্তি হতে আসা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৫ শতাংশ কমেছে বলে হিসাব দেখিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
শুক্রবার পরিস্থিতির আরো উন্নতি হয়েছে। শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মোট ৯৪৭ জন। আর ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৫৫ জন ডেঙ্গু রোগী। তার আগের ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয় মোট ১ হাজার ১৫৯ জন। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোর হাসপাতালে ভর্তি হয় ১ হাজার ১৬৭ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, চলতি বছরের শুরু থেকে এই পর্যন্ত ৩৬ হাজার ৬৬৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়। শুক্রবার সকাল নাগাদ সারা দেশে মোট ৮ হাজার ৭৬৩ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। এর মধ্যে ঢাকার ৪১টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ৫ হাজার ৪৬ জন। বাকি জেলাগুলোর বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ৩ হাজার ৬৮৭ জন। সরকারি হিসেবে চলতি বছর এপ্রিলে ৫৮ জন, মে মাসে ১৯৩ জন, জুনে ১ হাজার ৮৮৪ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। জুলাই মাসে তা এক লাফে ১৬ হাজার ২৫৩ জনে পৌঁছায়। আর আগস্টের প্রথম আট দিনেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৮ হাজার ২০৭ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, রোগীর সংখ্যা বাড়লেও রোগমুক্ত হয়ে বাড়ি ফেরা মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোতেই সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে গেছে। এসব জেলায় ভর্তি হয়েছে মোট ২৩৮ জন। আগের দিন ২৮৩ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছিল। এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ২২৩ জন, খুলনা বিভাগে ১৪৯ জন, বরিশাল বিভাগে ১৬৭ জন, রাজশাহী বিভাগে ১০৪ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৭০ জন, রংপুর বিভাগে ৭৫ জন এবং সিলেট বিভাগে ২৯ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে গেছে গত ২৪ ঘণ্টায়। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গতকাল শুক্রবার ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় লিপি আক্তার (৩০) মারা গেছেন। তিনি গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার মাহাবুব খলিফার স্ত্রী।
বরিশাল শেরে-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় আরো এক ডেঙ্গু রোগী গতকাল মারা গেছেন। তার নাম মো. মজিবর রহমান (৫৫)। তিনি বরগুনা সদরের বাসিন্দা এবং বরগুনা রাইফেলস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মতলব দক্ষিণ উপজেলার নায়েরগাঁও দক্ষিণ ইউনিয়নের কাচিয়ারা গ্রামের সরকারবাড়ির মমিন সরকারের মেয়ে সায়েরা (৮) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিত্সাধীন অবস্থায় বুধবার রাতে মগবাজারের রাফমনি হাসপাতালে মারা যায়। ১ আগস্ট জ্বর নিয়ে সে প্রথমে বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়। গত সোমবার তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে মগবাজার রাফমনি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিত্সা দেওয়া হয়। বুধবার রাত ৯টার দিকে সে মারা যায়।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর মুগদা মেডিকক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে দুই তরুণীর মৃত্যু হয়েছে। এরা হলেন আজমিনা আক্তার নূপুর (২৫) এবং নূর জাহান (২৬)। শুক্রবুার সকালে ওই হাসপাতালের পরিচালকের অফিসের সামনে টাঙানো দৈনিক ডেঙ্গু রিপোর্টে দুজনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুজনের মধ্যে নূপুর ডেঙ্গু নিয়ে বৃহস্পতিবার হাসপাতালে ভর্তি হন। ঐ দিনই মারা যান তিনি। আর নূর জাহান ডেঙ্গু নিয়ে এই হাসপাতালে এসেছিলেন মঙ্গলবার। বুধবার তিনি মারা যান।
এছাড়া গতকাল ঠাকুরগাঁও থেকে দিনাজপুরে আনার পথে অপি রানী রায়ের (১৭) মৃত্যু হয়েছে। মেধাবী শিক্ষার্থী অপি রাণী রায় ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকেল উপজেলার লেহেম্বা গ্রামের অনুকূলচন্দ্র রায়ের একমাত্র মেয়ে। সে এবার রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ নিয়ে পাশ করে।
অন্যদিকে, শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বেলা ১১টায় বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ, রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা, ডা. সমীর কান্তি সরকার প্রমুখ। সভায় জানানো হয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল-২ এর এক্সটেনশন হিসেবে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে প্রয়োজনে রোগী ভর্তি করা শুরু করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এছাড়া শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালকেও ডেঙ্গু রোগী ভর্তির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।
এছাড়া ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অরথোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন (নিটোর) ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভার্টিক্যাল এক্সটেনসনে অতিরিক্ত ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। সভায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেকের নির্দেশনা অনুযায়ী, পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে আয়োজিত পশুর হাটে ডেঙ্গু প্রতিরোধে লার্ভা ধ্বংস ও এডিস মশা নিধন এবং কোরবানির বর্জ্য অপসারণে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সকল জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও মেয়রদের অনুরোধ জানানো হয়। দীর্ঘ এই ছুটির মধ্যেও সকল পর্যায়ের হাসপাতালে চিকিত্সা সেবা ও কার্যক্রম তদারকি অব্যাহত রয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হন আতিকুল ইসলাম। হাসপাতালের ৫৩২ নম্বর কেবিনে ভর্তি ছিলেন। এক সপ্তাহ চিকিত্সা শেষে গতকাল বাসায় ফিরেছেন। তার রক্তের প্লাটিলেট কমে গিয়েছিল, পেটে ও ফুঁসফুসে পানি জমে ছিল। তার স্ত্রী রাজধানীর একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি বলেন, ডেঙ্গুর তিনটি টেস্টের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি মানা হলেও অন্যান্য টেস্টের ক্ষেত্রে হাসাপাতালের নির্ধারিত ফি নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকবার এক্সরে ১ হাজার টাকা এবং আলট্রাসোনোতে ২ হাজার ৫০০ টাকা নেওয়া হয়। অন্যদিকে যাদের প্লাটিলেট দরকার হয়, তাদের প্রত্যেকবার রক্তের প্লাটিলেটের জন্য ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়।
ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয় সুমাইয়া আক্তার (৬)। শিশুটির পেটে ও ফুসফুসে পানি জমে। রক্তের প্লাটিলেট দিতে হয়েছে। পাশাপাশি প্লাজমাও লেগেছে তার। শিশুটির বড়ভাই সাগর জানায়, প্রথমে তারা শাহজাহানপুরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানে তিন দিন ভর্তি থাকার পর অবস্থা খারাপ দেখে দ্রুত নিয়ে আসেন হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে এক সপ্তাহ চিকিত্সা শেষে বাসায় ফিরেছেন। চিকিত্সার জন্য প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে পুরান ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করান বেসরকারি চাকরিজীবী আব্দুস ছালাম। রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় হাসপাতালে শিশুটিকে প্লাটিলেট দিতে নেওয়া হয় ৩০ হাজার ৫০০ টাকা। আব্দুস ছালাম বলেন, বেসরকারি চাকরি করি। মাস শেষে মাপা মাইনে পাই। তার উপর হঠাত্ মেয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়। টাকার দিকে তাকাইনি। মেয়ে সুস্থ হয়েছে এটাই শুকরিয়া। তবে হাসপাতালের দিনগুলোর কথা মনে হলেই আঁতকে উঠি। হাসপাতালে মেয়ের চিকিৎসার বিল হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, একজন ডেঙ্গু রোগীর দৈনিক ব্যয় হচ্ছে গড়ে ১০-১৫ হাজার টাকা। ডেঙ্গুর NS1 পরীক্ষা করতে সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা, CBC পরীক্ষার জন্য নেওয়া যাবে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা, IgG ও IgM এই দুটি পরীক্ষা করাতে হবে ৫০০ টাকা টাকা নিলেও অন্যান্য টেস্টের জন্য নেয়া হচ্ছে হাসপাতালগুলোর নিজস্ব ফি। রোগীর চাপ বাড়ায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হতে না পেরে অনেকেই ছু্টছেন বেসরকারি হাসপাতালে। টাকার দিকে না তাকিয়ে রোগীর চিকিত্সার জন্য সব মেনে নিচ্ছেন স্বজনরা। চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বজনরা।
জানা গেছে, শরীরের রক্তের প্রোটিন ‘অ্যালবুনিল’ বেশি কমে গেলে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের প্রতিদিন একটা ‘অ্যালবুটিক ইনজেকশন’ দিতে হয়। এর দাম ৭ হাজার টাকা। এ ছাড়া, প্রতিবার রক্তের ক্রসম্যাচিং করতে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে। প্রত্যেক রোগীকে একাধিকবার এক্সরে, আলট্রসোনগ্রাফি করতে হয়। হাসপাতাল ভেদে সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হয় এর ফি।
এ ব্যয় সরকারি হাসপাতালের তুলনায় ৫-৭ গুণ বেশি। অর্থাত্ একজন ডেঙ্গু রোগীর সরকারি হাসপাতালে দৈনিক গড়ে যেখানে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা খরচ হচ্ছে সেখানে বেসরকারি সাধারণ হাসপাতালগুলোতে দৈনিক ব্যয় হচ্ছে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। আবার কিছু বেসরকারি হাসপাতাল আছে যেখানে খরচ আরো অনেক বেশি।
বাংলা৭১নিউজ/এবি