বাংলা৭১নিউজ, রংপুর প্রতিনিধি: রংপুরের গঙ্গাচড়া সদরের ষাটোর্ধ আব্দুল হাকিম। গত শুক্রবার খবর পান তিস্তায় আসা বন্যার পানিতে তার মেয়ের বাড়ি তলিয়ে গেছে। তারা খুব কষ্টে আছে। গতকাল শনিবার সকালে তিনি মেয়েকে দেখতে পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে আসেন উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের ইচলী (এসকেএস’র বাজার) এলাকায়।
সেখান থেকে আরো দুই কিলোমিটার পথ যেতে হবে মেয়ের বাড়ি শংকরদহ গ্রামে। কিন্তু পানির তোড়ে সেতু ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সেখানে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিলেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে আব্দুল হাকিম বলেন, ‘শুনচু বানের পানিত বেটির (মেয়ে) বাড়ি তলে গেইচে। কষ্ট করি দেইকপার আসনু-তাওতো যাবার পাওনা। এই বুড়া বয়সে মুই অ্যালা ক্যামন করি যাং।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তিস্তার স্রোতে সাঁতার কেটে হলেও ওই পথ দিয়েই যেতে হবে শংকরদহ। বিকল্প চিন্তা করলে পার্শ্ববর্তী লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ হয়ে কমপক্ষে আরো পাঁচ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে। যদিও সে পথেও অনেক স্থানে বিচ্ছিন্ন সড়কে পানি পার হয়ে যেতে হবে। শুক্রবারের বন্যায়ও রংপুরের গঙ্গাচড়ার চরাঞ্চলে রাস্তাঘাট ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গতকাল শনিবারও কোথাও যেতে এখানকার মানুষের একমাত্র সম্বল ছিল কলার ভেলা।
রংপুরের তিস্তাপারে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও চরম দুর্ভোগে পড়েছে চরগ্রামের পরিবারগুলো। থকথকে কাঁদাপানিসহ প্রবল স্রোতে নড়বড়ে হয়ে যাওয়া বাড়িতে ফিরতে পারছে না তারা। তিস্তার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন শুরু হওয়ায় আতঙ্কে লোকজন ঘড়বাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে তিস্তাপারে বন্যা দেখা দেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার উজান থেকে আসা ঢলে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেতে থাকে। ওইদিন রাতে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদসীমার (৫২ দশমিক ৬০) ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে ভাটি অঞ্চল রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ২৭টি চরগ্রামের প্রায় সাত হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
এলাকাগুলোর মধ্যে নোহালী ইউনিয়নের ফোটামারী, চর নোহালী, মিনার বাজার, চর বাগডোহরা ও নোহালী সাপমারী এলাকায় এক হাজার ৫০০ পরিবার, কোলকোন্দ ইউনিয়নের চিলাখাল, মটুকপুর, বিনবিনা ও সাউদপাড়া এলাকায় এক হাজার ৫০০ পরিবার, গঙ্গাচড়া সদর ইউনিয়নের ধামুর ও দোলা গান্না এলাকায় ৫০০ পরিবার, লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের শংকরদহ, পূর্ব ইচলী, জয়রামওঝা ও পশ্চিম ইচলী এলাকায় দুই হাজার পরিবার, গজঘণ্টা ইউনিয়নের ছালাপাক, রমাকান্ত, মহিষাশুর, কালির চর ও রাজবল্লভ এলাকায় ৫০০ পরিবার, মর্নেয়া ইউনিয়নের নিলারপাড়া, চর মর্নেয়া, আলাল চর, চর মৌভাষা, এলাকায় ৫০০ পরিবার ও আলমবিদিতর ইউনিয়নের ব্যাঙপাড়া, জুম্মাপাড়া ও জেলেপাড়ায় ৫০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
সরেজমিনে গতকাল শনিবার বন্যাকবলিত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তিস্তা বাঁধসহ উঁচু স্থানে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলো এখনো তাদের বাড়িতে ফিরতে পারেনি। গতকাল সকাল থেকে পানি কমতে শুরু করলেও চরের বাড়িগুলোর আঙ্গিনায় থকথকে কাঁদাপানি বিরাজ করছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি এখনো। পাশের বাড়িসহ হাটবাজারে যেতে কলার ভেলাই একমাত্র ভরসা চরের মানুষের।
লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের শংকরদহ এলাকার মনছুর আলীর ঘরে হাঁটু পানি বিরাজ করছে। তিনি বলেন, ‘চুলা ধরবার উপায় নাই। না খ্যায়া আর কতক্ষণ থাকা যায়।’
পূর্ব ইচলী গ্রামের জোবেদা বেগম সন্তানদের নিয়ে দুই দিন ধরে নিরাপদ স্থানে আছেন। তিনি বলেন, ‘পানিতো কমছে-তয় বাড়িত যামু ক্যামনে! বান আইসা ঘড়ের খুঁটি-বেড়া নড়বড়া কইরছে। অ্যালা ভাল করতি ট্যাকা পাঁও কোনটে!’ হঠাৎ বান (বন্যা) আসায় বাড়িতে কোমর পানি বিরাজ করায় পালিত হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল নিয়ে বেশি বিপদে আছেন বলে জানান তিনি।
হঠাৎ করে আসা বন্যার পানি নেমে গেলেও গঙ্গাচড়ার বিভিন্ন এলাকায় তিস্তার ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত কয়েকদিনে আলমবিদিতর ইউনিয়নের পাইকান, কোলকোন্দ ইউনয়নের বিনবিনা ও লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের ইচলী এবং শংকরদহ এলাকায় ১৩০ পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। গত শুক্রবার সকালে রংপুরের গঙ্গাচড়া ও লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী নবনির্মিত দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতুর ইচলী এলাকায় একটি সেতু ধসে যাওয়ায় গত দুই দিন ধরে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার সকালে নদীভাঙনে ইচলী এলাকায় আকলিমা, ওয়ারেছ আলী, মোজাহার আলী, আব্দুল বারেক, আব্দুস সালাম, আনোয়ার হোসেন, আমিনুর রহমান, হযরত আলী, ওলিয়ার রহমানসহ বেশ কয়েকটি পরিবারের পাকা বাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এ সময় পানি টলমল করা চোখে আকলিমা বলেন, ‘হামার সউগ শ্যাষ হয়্যা গেইল বাহে। অ্যালা হামাক কায় দেবে জাগা (জায়গা) আর কোনটে থাকমো আল্লায় জানে।’ এলাকার অনেকে ভাঙন আতঙ্কে তাদের ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।’
লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী জানান, ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে তিস্তার চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তাঁর ইউনিয়নে অন্তত দুই হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পানি কমতে শুরু করলেও তাদের দুর্ভোগ বেড়েছে। তিস্তার তীব্র ভাঙনে চোখের সামনে পাকা ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হচ্ছে। চরম দুর্ভোগে পড়েছে গৃহহীন পরিবারগুলো।’
গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ এনামুল কবির বলেন, ‘দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ হঠাৎ আসা বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে উল্লেখ করে তিনি জানান, দ্বিতীয় তিস্তা সেতু সড়কের একটি সেতু ধসে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি জানান, ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেতুর ভাঙনরোধে আপাতত বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ অনলাইন।
বাংলা৭১নিউজ/জেএস