রাজধানীর শাহজাদপুরে সৌদিয়া হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দুইজন। তবে তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানাতে পারেনি পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস।
ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং মরদেহের সুরতহাল শেষে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক ধারণা, ভিকটিম চারজন আগুনে সৃষ্ট ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। প্রাথমিকভাবে নিহতদের মধ্যে একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তিনি আজ সকাল ৮টায় হোটেলটিতে ওঠেন।
সোমবার (৩ মার্চ) দুপুরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, যে ভবনটিতে আগুন লাগে সেটি ছয়তলা বিশিষ্ট। নিচতলায় তিনটি দোকান রয়েছে, দ্বিতীয় তলায় মেয়েদের একটি বিউটি পার্লার। তিনতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত সৌদিয়া হোটেল। ষষ্ঠ তলার অর্ধেক অংশে হোটেল আর বাকি অর্ধেক খোলা ছাদ। আগুনের ঘটনায় ২য় তলার বিউটি পার্লার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। নিচতলা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তৃতীয় তলা থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত যেখানে হোটেল অবস্থিত সেখানে আগুনে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
ভবনের নিচ তলায় আছে রুমা ডিজিটাল নামে একটি স্টুডিও। এ ছাড়া রয়েছে মা ডোর সেন্টার অ্যান্ড ফার্নিচার ও মুন্নি এন্টারপ্রাইজ নামে দুটি দোকান।
ভবনের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, চারতলায় হোটেলের একটি কক্ষের সামনে একটি মরদেহ পড়ে রয়েছে। আর ষষ্ঠ তলার ছাদের গেটের সামনে তিনটি মরদেহ পড়ে রয়েছে। ভবনের ভেতরে বিভিন্ন ফ্লোরে কাঁচের ভাঙা টুকরো দেখা গেছে।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস বলছে, ৪র্থ তলায় যে মরদেহটি পাওয়া যায় সেটি আসলে একটি কক্ষের শৌচাগার থেকে পাওয়া যায়। বাকি তিনটি মরদেহ ষষ্ঠ তলার ছাদের গেটের সামনে পড়ে ছিল। তবে গেটটি তালাবদ্ধ ছিল।
এ বিষয়ে গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেছুর রহমান বলেন, মরদেহগুলো আগুনের তাপে কিছুটা পুড়ে গেছে। আমাদের এবং ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক ধারণা এ চারজন আগুনে সৃষ্ট ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। আমরা এখন পর্যন্ত একজনের পরিচয় নিশ্চিত করতে পেরেছি। বাকি তিনজনের পরিচয় জানা যায়নি।
তিনি বলেন, আমরা ঘটনাস্থলে এসে বিউটি পার্লার এবং হোটেলের কাউকে পাইনি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও এই দুই প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্তৃপক্ষ বা কর্মচারীকে পাওয়া যায়নি।
ছেলেকে বিদায় জানাতে এসে চিরবিদায় নিলেন বাবা
পুলিশ জানিয়েছে, নিহত যে ব্যক্তির পরিচয় জানা গেছে তার নাম মিরন জম্মাদার (৬০)। তার বাড়ি পিরোজপুর জেলায়। তিনি আজ (সোমবার) সকাল আটটায় হোটেলটিতে ওঠেন।
নিহতের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিরনের ছেলে মুবিন জমাদ্দার আগামীকাল সন্ধ্যার একটি ফ্লাইটে সৌদি আরবে যাওয়ার কথা রয়েছে। মুবিন শাহজালাল বিমানবন্দরের কাছাকাছি একটি হোটেলে উঠেছেন। আর বাবা মিরন শাহজাদপুরের এই হোটেলটিতে ওঠেন। নিহত মিরন আজ সকালে তার বোনের স্বামী হিরন তালুকদারের সঙ্গে পিরোজপুর থেকে ঢাকায় আসেন।
সকাল ৮টায় হোটেলটিতে ওঠেন। হোটেলে ওঠার পর তিনি আবার বাইরে বের হন, নাশতা করেন। এরপর হোটেলে যান বিশ্রাম নিতে। এরই মধ্যে লাগে আগুন। আগুন লাগার পর জীবন বাঁচানোর জন্য ফোন দেন বোনের স্বামী হিরনকে।
হিরনকে ফোন দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মিরন বলেন, আমি বাঁচার কোনো পথ পাচ্ছি না। চারদিকে ধোঁয়া, দম বন্ধ হয়ে আসছে। এই কথা বলার পর ফোন কেটে যায় মিরনের। পরে ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণের পর মিরনের মরদেহ চারতলা থেকে উদ্ধার করে।
নিহতের বোনের স্বামী হিরন তালুকদার বলেন, আমরা আজ সকালে এসে হোটেলটিতে উঠি। সকালে আসার পর মিরন হোটেলের পাশে একটি রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা করে ফের হোটেলে যান এবং আমাকে বলেন আপনি নাস্তা করে আসেন, আমি একটু বিশ্রাম নেই।
এর কিছুক্ষণ পরে আগুন দেখে হোটেলের নিচে দৌড়ে আসি। এসে দেখি পুরো হোটেল আগুনে ধোঁয়াচ্ছন্ন। তখনই মিরন আমাকে ফোন দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, চারদিকে ধোঁয়া উনি কোথাও যাওয়ার জায়গা পাচ্ছেন না। তিনি হোটেলের চারতলার রুমে ছিলেন। রুম নম্বর ৪০২।
আগুনের সূত্রপাত নিয়ে যা বলছে প্রত্যক্ষদর্শীরা
এদিকে প্রত্যক্ষদর্শী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছেন, আগুনের সূত্রপাত ঘটে দ্বিতীয় তলার বিউটি পার্লার থেকে। পরে বিউটি পার্লার থেকে আগুন বাড়তে থাকে আর প্রচণ্ড ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে ভবনটির নিচ তলার মা ডোর সেন্টার অ্যান্ড ফার্নিচারের মালিক ফারুক হোসেন বলেন, আগুন লাগে বেলা ১২টা ১৫ মিনিটের দিকে। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে দোকানের ক্যাশ বক্স নিয়ে বের হয়ে যায়। আল্লাহর রহমতে আমার দোকানে তেমন ক্ষতি হয়নি। তবে জানতে পেরেছি দুই তলার বিউটি পার্লার থেকে আগুনটা সৃষ্টি হয়। সেখানে নাকি এসি থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নেভান। কিন্তু আগুনে প্রচণ্ড ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়, যা ওপরের দিকে চলে যায়।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, চারতলার বাথরুমে যে মরদেহটি পাওয়া যায় সেই ব্যক্তি হয়ত জীবন বাঁচাতে বাথরুমের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে বাথরুমের ভেতরে আগুনে সৃষ্ট ধোঁয়ার কারণে দম বন্ধ হয়ে মারা যান তিনি। আর বাকি তিনজন জীবন বাঁচাতে ছাদে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু ছাদ বন্ধ থাকায় তারা আর যেতে পারেনি। সেখানেই ধোঁয়ার কারণে দম বন্ধ হয়ে মারা যান।
এর আগেও আগুন লেগেছিল ভবনটিতে, ছিল না নিরাপত্তা ব্যবস্থা
প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবনটিতে ছয়-সাত মাস আগে একবার আগুন লেগেছিল। তখন কোনও প্রাণহানি না ঘটলেও আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ভবনটিতে।
স্থানীয় বাসিন্দা মুন্না রহমান বলেন, এই ভবনটিতে ৬-৭ মাস আগেও একবার আগুন লেগেছিল। ভবনটির অবস্থা খুব খারাপ। এখানে এমন চিপা সিঁড়ি যে আগুন লাগলে কোনও মানুষ দ্রুত বের হয়ে যে প্রাণ বাঁচাবে সেই ব্যবস্থাও নেই।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবনটিতে কোনও ধরনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। ভবনটি মডিফাই করে হোটেল ভাড়া দেওয়া হয়। এ ছাড়া নিচতলা ও দ্বিতীয় তলায় চারটি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হয়। ভবনটির সিঁড়ি একদম ছোট এবং সরু। দুজন মানুষ একসঙ্গে এই সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে পারবে না। এছাড়া ভবনে কোনো ধরনের ফায়ার এক্সিট ছিল না। অন্যদিকে ভবনের কোনও ফ্লোরে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা দেখা যায়নি।
এদিক দুপুর ১২টা ১৭ মিনিটের দিকে আগুন লাগার সংবাদ পায় ফায়ার সার্ভিস। পরে তাদের দুটি ইউনিট প্রায় আধা ঘণ্টা কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ