একজন ব্যক্তির আদর্শ ওজনের তুলনায় যদি ১০ ভাগ ওজন বেশি থাকে তবে তিনি স্থূলতায় ভুগছেন বলে ধরে নেওয়া হয়। এর মানে তিনি বেশি ওজনজনিত সমস্যায় ভুগছেন। বাংলাদেশেও সমস্যাটি দিন দিন বেড়ে চলছে। ফলে কিডনি, লিভার, ডায়াবেটিস, হার্টের রোগসহ নানা ধরনের অসুখে ভুগছেন অনেকে। এ থেকে বাঁচার অন্যতম পন্থা খাবার নিয়ন্ত্রণ করা। এরপর নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। যেমন—নিয়মিত শরীরচর্চা, ঘুমাতে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠা, পর্যাপ্ত ঘুমানো ইত্যাদি জানালেন এভার কেয়ার হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ তামান্না ইসলাম। তাঁর মতে, মূলত বেশি খাবার খাওয়ার ফলেই ওজন বাড়তে শুরু করে। এ জন্য ব্যালান্স ডায়েট মেনে চললে ওজন কমানো যায়।
বুঝেশুনে খাবার খাওয়া
চটজলদি ওজন কমাতে খাবার খেতে হবে জেনে-বুঝে। শরীরে যাতে ক্যালরির মাত্রা না বাড়ে, নজর রাখতে হবে সেদিকেও। তেলে ভাজা খাবার, কোল্ড ড্রিংকস, সাদা পাউরুটি, মিষ্টি ও জাংক ফুড এড়িয়ে চলতে হবে। ভাত-রুটি খেতে হবে পরিমাণ বুঝে। শরীরকে সচল রাখতে কার্বোহাইড্রেটের প্রয়োজন আছে। এ জন্য ভাত-রুটি বন্ধ করে দেওয়া উচিত নয়। তবে পরিমাণে কম খান। পরিবর্তে ফলমূল, সবজি জাতীয় খাবারের প্রতি মনোযোগ দিন। চা, কফি, ঠাণ্ডা পানীয় ইত্যাদি খাওয়া কমিয়ে দিন।
না খেয়ে থাকা নয়
অনেকেই মনে করেন, না খেয়ে থাকলেই বুঝি ওজন কমে। ধারণাটি একেবারেই ভুল। অতিরিক্ত ওজন কমাতে না খেয়ে থাকা কাজের কথা নয়। অনেকেই ওজন কমাতে খাওয়া কমিয়ে দেন কিংবা একবেলা খান না কিংবা এতটাই কম খান যে সারা দিন চলার মতো শক্তিও থাকে না। খাবার খেতে হবে। তবে হিসাব করে, পরিমাণমতো আর জেনে-বুঝে। বারডেম জেনারেল হাসপাতালের পুষ্টি বিভাগের সাবেক প্রধান পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার আলো বলেন, ‘ওজন কমাতে খাবার নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
কিন্তু খাওয়া বাদ দেওয়া চলবে না। রোগ প্রতিরোধের জন্যও চাই সুষম খাবার। বুঝেশুনে না খেলে ওজন বাড়বে এটা যেমন ঠিক, তেমনি খাবার খেয়েই বাড়তি ওজন কমাতে হবে। এ জন্য সারা দিনের খাবারে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, শাকসবজি ও ফলমূল জাতীয় খাবার রাখতে হবে।
ব্যালান্স ডায়েট জরুরি
ওজন কমাতে দারুণ ভূমিকা রাখে ব্যালান্সড ডায়েট। মানুষকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে ব্যালান্সড ডায়েটের বিকল্প নেই। ডায়েট ঠিক না থাকলে চুল পড়ে, ত্বকের উজ্জ্বলতা কমে যায়, হাত ও পায়ের নখ ফেটে যায়, সহজেই ভেঙে যায়। অনেকেই রোগা হয়ে পড়েন। এ জন্য নিয়মিত সঠিক ডায়েট মেনে চলা জরুরি।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
ওজন কমাতে কোন খাবার কী পরিমাণ খাবেন এটা নিয়ে দ্বিধায় ভোগেন বেশির ভাগ মানুষ। তার আগে আপনার ওজন বেশি কি না এটা জানতে হবে। এ জন্য পুষ্টিবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। তিনি আপনার ওজন ও উচ্চতার হিসাব করে বের করবেন আপনি বেশি ওজন সমস্যায় ভুগছেন কি না। এরপর পুষ্টিবিদ আপনার ওজন ও উচ্চতার তারতম্যভেদে একটি সঠিক ব্যালান্সড ডায়েট চার্ট অথবা খাদ্যতালিকা নির্ধারণ করে দেবেন। এমন ডায়েটে সুষম খাদ্যতালিকা থেকে কিছু না কিছু নির্বাচন করে নেওয়া হয়। যেমন—কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফলমূল, খনিজ, ভিটামিন ইত্যাদি।
ওজন কমাতে সঠিক খাদ্যতালিকা
ওজন কমানোর জন্য আপনার খাদ্যতালিকাটি পাঁচ থেকে ছয় বেলায় ভাগ করে নিন। সকালের খাবারে ক্যালরির পরিমাণকে প্রাধান্য দিতে হবে। সকালে বেশির ভাগ মানুষ পরোটা কিংবা ভাত খান। আপনার ওজন বেশি হলে পরোটা ও ভাত খাওয়ার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পরিবর্তে লাল আটার রুটি খান। ডিম অমলেট না খেয়ে সিদ্ধ করে খান। ডিমে প্রচুর প্রোটিন রয়েছে, যা অনেকক্ষণ পেট ভরিয়ে রাখে। এ ছাড়া সকালের খাবারে মুরগির স্যুপ ও টক দই রাখতে পারেন।
সকালের নাশতা খাওয়ার পর ১০ থেকে ১১টার দিকে ফল খেতে পারেন। মৌসুমি ফল হলে ভালো হয়, বিশেষ করে পেঁপে, পেয়ারা, নাশপাতি, আমড়া কিংবা জাম্বুরা, আম ইত্যাদি।
দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে দুপুরের খাবার খান। দুই থেকে তিন কাপ ভাত, এক কাপ সবজি, সালাদ এক কাপ, মাছ বা মাংসের টুকরা এবং অর্ধেক কাপ ডাল বেছে নিন। লাল চালের ভাত খান।
বিকেলের নাশতায় ফাস্টফুড জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। পরিবর্তে ছোলা, ফলের সালাদ, সরবত খান।
রাতের খাবার ৯টার মধ্যে খেয়ে নিন। ওজন কমাতে চাইলে রাতে শর্করাজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন। চেষ্টা করুন স্যুপ খাওয়ার। মুরগির মাংস বা ডালের স্যুপ খেতে পারেন কিংবা ডালের মধ্যে বিভিন্ন রকম সবজি মিশিয়ে এক বা দুই টুকরা মুরগির মাংস দিয়ে খেতে পারেন। চেষ্টা করুন ভাতের পরিবর্তে অন্য কিছু দিয়ে পেট ভরাতে।
দুপুর ও রাতের খাবারে সবাই কমবেশি মাছ খেয়ে থাকি। ওজন কমাতে চাইলে মাছ না ভেজে রান্না করে খেতে হবে। কারণ ১ চা চামচ তেল থেকে প্রায় ৪৫ কিলোক্যালরি পাওয়া যায়। এ জন্য ওজন কমাতে চাইলে খাদ্যতালিকা থেকে যথাসম্ভব তেল বাদ দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আরেকটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ। সকালের চেয়ে রাতের খাবার অবশ্যই পরিমাণে কম হতে হবে। সকালে একটু বেশি খেলেও তেমন অসুবিধা হয় না।
কারণ সারা দিন নানা কাজের মধ্য দিয়ে আমরা প্রচুর ক্যালরি বার্ন করি। কিন্তু রাতে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার ফলে কায়িক পরিশ্রম হয় না বলে ক্যালরি বার্নের সুযোগ থাকে না। এতে ওজন বেড়ে যায়। ওজন কমাতে টক দই খুব ভালো কাজ করে। এ জন্য প্রতি বেলা খাবার খাওয়ার পর এক কাপ টক দই খেতে পারেন। এটা খাবার হজম করতে এবং ক্যালরি বার্ন করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া প্রতিদিন দুই থেকে পাঁচটি বাদাম খেতে পারেন। বাদাম শরীরের ফ্যাট বার্ন করে।
খাদ্যতালিকায় ওট মিল ও প্রচুর সালাদ রাখুন। মনে রাখতে হবে, ওজন কমানোর জন্য আমাদের শর্করাজাতীয় খাবার গ্রহণ কমাতে হবে। পরিবর্তে প্রোটিন, ফলমূল ও সবজি জাতীয় খাবার বেশি রাখতে হবে। রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা ওজন কমানোর মূল চাবিকাঠি। তাই প্রতি বেলা খাবারের মাঝে খুব বেশি বিরতি রাখা যাবে না।
বিরতি বেশি হলে রক্তে শর্করা বেড়ে ওজন বৃদ্ধি পায়। রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে প্রতি বেলার খাবারের মাঝে চার ঘণ্টা বিরতি রাখুন। গবেষণা থেকে জানা গেছে, সময়মতো খাওয়া শরীরে মেদ জমতে বাধা দেয়। এ ছাড়া খাওয়ার আগে পানি খেয়ে নিতে পারেন। এতে পেট ভরে থাকার কারণে খাবার কম খাওয়া হয়।
ওজন কমানোর মাত্রা
ওজন ও উচ্চতা ভেদে আদর্শ ওজন ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। আপনার ওজন অতিরিক্ত হয়ে থাকলে কতটুকু কমাবেন তা একজন পুষ্টিবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করে নিন। কী কারণে ওজন বেড়েছে সেটা আগে জানা জরুরি; কিংবা ওজন বাড়ার ফলে শরীরের কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না তা জানা দরকার। এ জন্য রক্তের হিমোগ্লোবিন, কোলেস্টেরল মাত্রা, ডায়াবেটিস ও থাইরয়েডের কিছু টেস্ট করিয়ে নিন। বয়স চল্লিশের বেশি হলে কিডনি ও লিভারের পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে বেশি ওজন কমাতে যাওয়া ঠিক নয়। এ জন্য পুষ্টিবিদের পরামর্শ মেনে চলুন।
দরকার শরীরচর্চাও
শুধু খাবার নয়, এর সঙ্গে যদি নিয়মিত শরীরচর্চা করা যায় তবে তা ওজন কমাতে আরো বেশি কাজে দেয় বলে জানান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অনারারি মেডিক্যাল অফিসার ডা. মো. রায়হান উদ্দিন।
তাঁর মতে, শুধু যে ওজন কমানো তা নয়, বরং সুস্থ থাকার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিরই দিনে কিছু সময় শরীরচর্চা করা উচিত। সকালে ব্যায়াম করা বা হাঁটা সবচেয়ে ভালো। সকালে সময় করতে না পারলে অফিস বা কাজ থেকে ফেরার পরে সিঁড়ি দিয়ে (পাঁচতলা পরিমাণ) টানা তিনবার ওঠানামা করলেও অনেক উপকার পাওয়া যায়। হাঁটতে হলে কমপক্ষে টানা ৩০ মিনিট একই গতিতে হাঁটুন। এতেও উপকার পাওয়া যায়। শরীরের রক্ত সঞ্চালন বাড়ে, ফ্যাট বার্ন হয়। ব্যায়ামে ঘামের ফলে শরীর থেকে বর্জ্য বের হয়, মন ফুরফুরে থাকে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
অতিরিক্ত ওজন কমানোর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। তবে এগুলো তেমন ক্ষতিকর নয়। শুরুর দিকে অতিরিক্ত ক্ষুধাবোধ, শরীর দুর্বল অনুভূত হওয়া, মাথা ব্যথা, অবসাদ, ঘুম ঘুম ভাব পেয়ে বসতে পারে।
তবে শিগগিরই এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সঙ্গে শরীর মানিয়ে নেয়। ফলে আর কোনো অসুবিধা মোকাবেলা করতে হয় না।
বাংলা৭১নিউজ/এসএম