কোথাও কেউ নেই বাস্তব কিছু না। একটি নাটকের শেষ দৃশ্য। কিন্তু বাস্তবে কি এমন ঘটনা হয় না? ২০২০ সালের এই মার্চে আজিমপুর গোরস্থানে একটি লাশ দাফন হচ্ছে। এ লাশের পাশে আজ আত্মীয়-পরিজন কেউ নেই। বিশেষ ব্যবস্থায় দাফন। সারা শরীর বিশেষ প্রটেকশনে ঢাকা। গোরস্থানের কর্মীরা ছাড়া কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কা কা শব্দ করে আকাশে উড়ে গেল একটি কাক। আহারে! এই মানুষটি কি কয়েক মাস আগেও ভেবেছিলেন এভাবে তার দাফন হবে? মৃত্যু এক অনিবার্য সত্য। তাই বলে এভাবে শেষ যাত্রা? গোটা বিশ্ব এক নিষ্ঠুর মহামারীর আঘাতে আজ ল-ভ-। ভয়াবহ সময় অতিক্রম করছি আমরা। কেউ জানি না শেষ কোথায়? আমার আগামী কী? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চীনের উহানের একটি ছবি দেখলাম। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৮৭ বছর বয়সী লিউ কাই। তিনি বুঝতে পারছিলেন জীবনপ্রদীপ নিভে আসছে। সময় আর বেশি নেই। চলে যেতে হবে চিরতরে। মৃত্যুর হিমশীতল পরশ স্পর্শ করবে। এরপর কীভাবে শেষকৃত্য হবে এই বৃদ্ধ জানেন না। শুধু বুঝলেন তিনি চলে যাচ্ছেন। আর ফিরবেন না এ পৃথিবীতে। ডাকলেন একজন ডাক্তারকে। বললেন, আমার শেষ একটা ইচ্ছা আছে বাবা। আপনি কি পূরণ করতে পারবেন? সারা শরীর পার্সোনাল প্রটেকশন্স ইকুইপমেন্টস অ্যাপ্রোনের আবরণের ভিতর থেকে ডাক্তার বিস্ময় নিয়ে তাকালেন। এই মুহূর্ত বড় কঠিন। কেউ কারও জন্য কিছু করতে পারছে না। প্রিয়জনরা কেউ পাশে আসছে না। ডাক্তার নিজেও কাজ করছেন ঝুঁকি নিয়ে। সামান্য ভুলে তিনিও আক্রান্ত হতে পারেন। তবু বয়স্ক মানুষটির শেষ ইচ্ছা জানতে চান। বয়স্ক মানুষটি এবার বললেন, মৃত্যুর আগে সূর্যাস্ত দেখতে চাই। চোখের সামনে দেখতে চাই পৃথিবীর শেষ সূর্যটার ডুবে যাওয়া। এরপর অন্ধকারে তলিয়ে যাবে সবকিছু। আমিও। বৃদ্ধ ভেবেছিলেন, তার শেষ ইচ্ছা হয়তো পূরণ হবে না। কিন্তু ব্যবস্থা নিলেন ডাক্তার। রোগীকে সূর্য ডোবার মুহূর্তে হাসপাতালের বেডসহ নিজে নিয়ে আসেন খোলা আকাশে। দুজনের চোখের সামনেই সূর্যটা ডুবতে থাকে। অবাক বিস্ময় নিয়ে দুজনই তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে। দুজনই তাকিয়ে থাকলেন সূর্যটা একেবারে না ডুবে যাওয়া পর্যন্ত। পিপিই অ্যাপ্রোনের আবরণে ডাক্তারের চোখে অশ্রু কিনা বোঝা যাচ্ছিল না। সূর্যাস্তের পর সেই রোগীকে আবার নিয়ে আসা হয় হাসপাতালের ভিতরে। আহারে! কি করুণ দৃশ্য! কি কষ্ট আজ মানুষের!
উহানের পর একজন রোগী ধরা পড়লেন ইতালিতে। কিন্তু সরকার শুরুতে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। বরং স্বাভাবিকভাবে নিল সব। সেই খেসারত দিতে হচ্ছে এখন ইতালিকে। ইতালির শহরগুলো এখন মৃত্যুপুরী। করোনাভাইরাসের যমদূত ঘুরে বেড়াচ্ছে ইতালির শহরগুলোয়। রাস্তাঘাটে পিনপতন নীরবতা। মানুষ ঘরে বসে আছে। মাঝে মাঝে অ্যাম¦ুলেন্সের সাইরেনের শব্দ। এ শব্দে হিমশীতল হাওয়া বয়ে যায় প্রতিটি মানুষের শরীর ও মনে। কেউ আক্রান্ত হলেই ছুটে আসছে অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তার ও নার্স। নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে। গোটা বিশ্ব আজ ল-ভ-। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন কঠিন পরিস্থিতি দুনিয়ার মানুষ আর মোকাবিলা করেনি। কবরের নীরবতা শুরু হয়ে গেছে ব্যস্ত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোয়। আমরা জানি না দুনিয়ায় আবার স্বাভাবিকতা কখন ফিরবে। আমার মেয়ে থাকে বোস্টনে। ১০ দিন আগে ফোনে বলল, বাবা! আমি কি চলে আসব? তোমাদের ছেড়ে একা থাকা ভীষণ কষ্টকর এই মুহূর্তে। আমি বললাম, টিকিট পাঠাচ্ছি। চলে আয়। মেয়ে আবার বলল, এসে কিন্তু আমি হাসপাতাল অথবা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকব। তারপর তোমাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ। বিমানবন্দর থেকে কোয়ারেন্টাইনে। আমি বললাম, হোম কোয়ারেন্টাইনও হতে পারে। বাসায় একা রুমে তুমি আলাদা হয়ে গেলে। মেয়ে বলল, শুরুতে বাসায় আসতে চাই না। জানতে চাইলাম শরীর কেমন? বলল, ভালো আছি বাবা। বুঝতে পারি ওর মনটা খারাপ। টিকিট বুকিং দিলাম। মেয়ে আবার ফোন করল। বলল, বাবা! বোস্টন লকডাউন হয়ে যাচ্ছে। এরপর সারা আমেরিকা হবে। (তখনো লকডাউন ঘোষণা হয়নি।) সারা বিশ্ব হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম আসব না। ফ্লাইটে এলে রোগটা আমার হতে পারে, এরপর তোমাদের মাঝে ছড়াতে পারে। তারপর তোমাদের থেকে অন্যদের ছড়াতে পারে। তাই না আসাই ভালো। থেকে যাব। তোমরাও সাবধানে থাকো। মাকে সভা-সমাবেশে যাওয়া বারণ কর। তুমি তেমন বের হবে না। বাসার কাজে সহযোগীদের দিকে খেয়াল রাখবে। নিজে ভালো থাকতে হবে। অন্যদেরও ভালো রাখতে হবে। গাড়িতে, অফিসে, বাসায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখবে। প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনো। অকারণে বাসা থেকে বের হবে না। আমি কথা বলতে পারছিলাম না। বুকটা ধক্ ধক্ করে উঠল। ফ্লাইটের টিকিট বাতিল করলাম। কথা বাড়াই না। মেয়ে পড়ে আছে এক দেশে, আমরা আরেক দেশে। জীবনের কঠিনতম সময় অতিক্রম করছি আমরা সবাই। এর মাঝে আমার মা ফোন করে জানতে চাইলেন, বাবারে! সব ঠিক আছে তো? বললাম সব ঠিক আছে। চিন্তা করবেন না আপনি।
আসলে কি চিন্তা করব না? বাস্তবে আমরা কি ঠিক আছি? পেটে অসহ্য ব্যথা নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে একটি মেয়ে গেল ভর্তি হতে। মেয়েটি এসেছে বিদেশ থেকে। চিৎকার শুনে ডাক্তার-নার্সরা পালালেন। সবাই ভাবলেন করোনা রোগী এসেছে। ঠিকভাবে চিকিৎসা হলো না। মারা গেল মেয়েটি। পরে জানা গেল, আসলে সে করোনা রোগী নয়। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কেউ সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হতে গেলে আতঙ্ক তৈরি হয়। কেন এমন হচ্ছে? কারণ একটাই- আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই। আমরা শুধু কথাই বলছি। কাজ করছি কম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হিংসা, বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে এক গ্রুপ। মন্ত্রীরা কথা বলছেন বেশি। কাজ করছেন না কেউই। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী গত তিন মাসে কী করলেন জাতি জানতে চায়? হঠাৎ হঠাৎ উদয় হয়ে তারা লম্বা লম্বা বক্তৃতা দেন। আরে ভাই! আমি খারাপ সময়ে আছি; আপনারা মাননীয়রা আজগুবি বক্তৃতা দিয়ে কেন বিরক্তি বাড়াচ্ছেন। এই খারাপ সময়ে কেউ অতিকথন শুনতে চায়- বলুন? মৃত্যুভয় থেকে প্রবাসীদের ওপর অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। করাটাই স্বাভাবিক। রোগটা তাদের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে। কিন্তু তারা তো আসবেনই। এ দেশ আমাদের সবার। বিমানবন্দরে আসার পর তিন মাস ধরে সতর্ক অবস্থানে থাকলে আজ এত প্রশ্ন উঠত না। শুরু থেকে বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা রাখার দরকার ছিল। সামান্যতম সমস্যা দেখামাত্র তাদের হাসপাতালে পাঠানো অথবা আলাদা করে রাখার ব্যবস্থা করা যেত। এই হজ ক্যাম্প এক দিনে তৈরি করে ফেলেছেন সেনা সদস্যরা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ কাজটি কেন করতে পারল না? এতটা অদক্ষ হলে কি চলে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের লুটপাটের খবর প্রকাশ করতে করতে গত ১০ বছরে আমরা ক্লান্ত। ওরা লুটপাটে রেকর্ড করেছে। জরুরি মহামারী মোকাবিলার প্ল্যানের সময় কোথায়? আর মাননীয়দের বলছি, মহামারী প্রকৃতি-প্রদত্ত। এখানে বিশাল সফলতা দাবির কিছু নেই। অতিকথন বাদ দিন। বাস্তবতা তুলে ধরুন। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সবাইকে নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজ করুন। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের পাশে আছেন। নিজে সচেতন হোন, অন্যকে সচেতন করুন। এ সমস্যা সহজে শেষ হচ্ছে না। ভ্যাকসিন ও মেডিসিন তৈরি হচ্ছে বিশ্বে। সবকিছু ঠিকঠাক হতে সময় লাগবে। সামনে বিশ্ব অর্থনীতিতে আঘাত আসছে। সে আঘাত সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি নিন।
অন্ধকার কেটে যাবে। আবার আলোর রশ্মি ছড়িয়ে পড়বে গোটা বিশ্বে। বিজ্ঞানী দার্শনিক আইজ্যাক নিউটন বলেছেন, ‘আমি যদি মানুষের জন্য কিছু করে থাকি, তবে তা সম্ভব হয়েছে আমার ধৈর্য ধরে চিন্তা করার ক্ষমতার কারণে।’ কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এ সংকটে দেশবাসীর সামনে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আপনাদের জন্য আজ আমি প্রধানমন্ত্রী, জনগণের সেবা ও নিরাপত্তা দেওয়া আমার প্রধান কাজ। আমি চাইলে নিজে ঘরে বন্দী থাকতে পারতাম। তবু সাহস নিয়ে আপনাদের খোঁজখবর নিচ্ছি, বের হচ্ছি। কারণ আপনারাই আমার অক্সিজেন। আপনারা সুস্থ থাকলেই আমি সুস্থ। আপনাদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে কিছুই নেই।’ প্রিয় জাস্টিন ট্রডো! স্যালুট আপনাকে। আপনার কথা আগামীর বিশ্ব স্মরণে রাখবে। সাধারণ মানুষ স্বস্তি চায়। একটু আশ্বাস চায়। দেখতে চায় এই দুঃসময়ে রাষ্ট্রের আন্তরিকতাটুকু। মিথ্যার ফুলঝুরি না, বাস্তব দৃষ্টান্ত। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করুন। আল্লাহ সবার সহায় হবেন। ৬৩৮ সালে প্লেগে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম সেরা শাসক হজরত ওমর (রা.)। তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন প্লেগে আক্রান্ত তার শাসনাধীন প্রতিটি অঞ্চলে। এ সময়ে ৬৩৯ সালে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে জীবন দিয়েছিলেন সিরিয়ার গভর্নর আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ। রোগে আক্রান্ত মানুষকে নিয়ে কাজ করার সময় তাঁকে মদিনায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ওমর। তিনি যাননি। বলেছিলেন, আমার সৈন্য ও সাধারণ মানুষকে রেখে মদিনায় নিরাপদে যেতে পারি না। আমি তাদের সঙ্গে থেকেই কাজ করে যাব। মহামারী নিয়ে লুকোচুরির কিছু নেই। দুনিয়ার কোনো দেশই তা করছে না। লজ্জাবতী পাতার মতো আমাদের মাননীয় মন্ত্রীরা আশা করছি, আজব আজব তথ্য দেওয়া আজ থেকে বন্ধ করে দেবেন। তাদের বলি, দৃষ্টান্ত স্থাপনের চিন্তা নিয়ে কাজ করুন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখেছেন, ‘মঙ্গল দীপ জ্বেলে অন্ধকারে দু-চোখ আলোয় ভর প্রভু, তবু যারা বিশ্বাস করে না তুমি আছো, তাদের মার্জনা করো প্রভু…।’ সবাই নিজে ভালো থাকুন। অন্যকে ভালো রাখুন।
বাংলা৭১নিউজ/কৃতজ্ঞতা: লেখক : নঈম নিজাম, সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন