বাংলা৭১নিউজ,যশোর: বরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ৯২তম জন্মবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইল শহরের মাছিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মেছের আলী এবং মায়ের নাম মাজু বিবি। বাবা-মা আদর করে নাম রেখেছিলেন লাল মিয়া।
শিল্পী সুলতান ছিলেন মাটি ও মানুষের শিল্পী। তাঁর তুলিতে ফুটে উঠেছে গ্রাম বাংলার মেহনতি মানুষের চিত্র।
এস এম সুলতান ১৯৪১ সালে কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে প্রথম হন। শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দীর সহযোগিতায় অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন কোলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান এবং সোহরাওয়ার্দীর বাসায় থেকেই পড়াশোনা করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি খাকসার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৪ সালে শিক্ষা জীবনের ইতি টেনে শুরু করলেন বোহেমিয়ান জীবনের। চলে গেলেন কাশ্মির। সেখানে উপজাতিদের সঙ্গে শুরু করেন বসবাস। ফ্রিল্যান্স আর্টিষ্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। সে সময় হার্ডসন নামে এক কানাডিয়ান মহিলার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। তার সহযোগিতায় ১৯৪৬ সালে কাশ্মিরের সিমলায় তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয়।
দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭ সালে তিনি কাশ্মির ছেড়ে লাহোরে চলে যান। সে সময় শিল্পী ও পন্ডিত নাগী চুগতাই, শাকের আলী, শেখ আহম্মদের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালে লাহোরে ও ১৯৪৯ সালে করাচির ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনের চিত্র প্রদর্শনীতে তিনি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন।
১৯৫০ সালে নিউইয়র্কে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে ব্রুকলিন ইনস্টিটিউট অফ আর্ট প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের পক্ষে অংশ নিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রায় ২০টি প্রদর্শনীতে অংশ নেন তিনি। ১৯৫৩ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি কোন প্রদর্শনী করতে পারেননি। তবে ১৯৭৬ সালে ঢাকায় তার একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৫৪-১৯৭৬ এই ২২টি বছর তিনি নড়াইলের পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে তিনি ছাত্রছাত্রীদের ছবি আঁকায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। পাশাপাশি নিজ গ্রামে নন্দনকানন প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, ফাইন আর্ট স্কুল, নড়াইল শহরের কুড়িগ্রামে ফাইন আর্ট স্কুল এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৩ সালে যশোরে একাডেমি অব ফাইন আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যশোরের ফাইন আর্ট স্কুলটি পরে চারুপীঠ নামে পরিবর্তন করা হয় এবং কুড়িগ্রামের ফাইন আর্ট ইনষ্টিটিউটের নাম পরিবর্তন করে শিশুস্বর্গ নামকরণ করা হয়। ১৯৮৩ সালে প্রথম তিনি সরকারের সহযোগিতা পান।
জীবনের শেষ কটা দিন তিনি তার প্রিয় মাতৃভূমি নড়াইলেই বসবাস করেন তার প্রিয় পশুপাখি ও ভালবাসার মানুষদের নিয়ে। শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন তার স্বপ্নের শিশুস্বর্গ। সরকারি সহযোগিতায় নড়াইল শহরের কুড়্রগ্রিামে চিত্রা নদীর পাড়ে তার বাসভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর এই মহান শিল্পী তার ভক্তদের কাঁদিয়ে যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান।
জীবদ্দশায় তিনি ১৯৮২ সালে একুশে পদক, ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের রেসিডেন্ট আর্টিস্ট হিসেবে স্বীকৃতি পান। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা এবং ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদকসহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হন মহান এই শিল্পী।
শিল্পী সুলতানের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নড়াইলবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সুলতানের বসতবাড়ি সংলগ্ন ২ একর ৫৭ শতক জমিতে ২০০১ সালের জুলাই মাসে শিশুস্বর্গ ও ‘সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা’ নির্মাণ শুরু এবং ২০০৩ সালের জুলাই মাসে নির্মাণকাজ শেষ হয়। শিশুস্বর্গ চালুর পর এখানে প্রতি শুক্রবারে শিশুদের ছবি আঁকা শেখানো হয়। শিল্পীর আঁকা দুর্লভ ছবি, ব্যবহার সামগ্রী ও অন্যান্য জিনিসপত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নির্মাণ করা হয় সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা। এখানে রয়েছে শিল্পীর আঁকা বেশ কিছু দুর্লভ ছবি ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র। সেটি দর্শনার্থীদের জন্য নিয়মিত খোলা থাকে। বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটক ও সুলতান ভক্তরা দেখতে আসেন।
শিল্পী সুলতানের জীবদ্দশায় বাসভবনকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলেন একটি মিনি চিড়িয়াখানা। সুলতানের মৃত্যুর পর তা নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা চিড়িয়াখানায়। ওই সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকদের আগমন ঘটত। জীবজন্তু নিয়ে যাবার পর প্রাণহীন হয়ে পড়ে সুলতানের বাসভবন।
শিল্পী সুলতান জীবদ্দশায় শিশুদের নিয়ে চিত্রা নদীতে তার নৌকায় ছবি আঁকা শেখাতেন। মৃত্যুর পর নৌকাটি ডাঙ্গায় তুলে রাখা হয়েছে। সেটিকে মেরামত করে আবারও নদীতে ভাসানোর দাবি জানিয়েছেন শিল্পীর পালিত কন্যা নিহারবালা।
শিল্পীর বাগানবাড়িতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এসএম সুলতান বেঙ্গল চারুকলা মহাবিদ্যালয়। ভবন না থাকায় শিশুস্বর্গে অস্থায়ীভাবে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। এমপিওভূক্তি না হওয়ায় শিক্ষকরা বিনাবেতনেই কাজ করে যাচ্ছেন।
সুলতানের ৯২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সংগ্রহশালা চত্বরে আজ কোরআনখানি, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, শিল্পীর কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ, আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল ও পুরষ্কার বিতরণের আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া আগামী ২৯ থেকে ৩১ আগস্ট তিনদিনব্যাপী এসএম সুলতান শিশু চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘সুলতান উৎসব’ এবং এসএম সুলতান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আগামী ১ সেপ্টেম্বর চিত্রা নদীতে ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলা৭১নিউজ/সিএইস