বাংলা৭১নিউজ,(সাতক্ষীরা)প্রতিনিধি: পরিবারের অভাবের তাড়নায় মোটরভ্যান চালানো শুরু করে মাদরাসা ছাত্র শাহিন মোড়ল। বাবা হায়দার আলী মোড়লও ভ্যানচালক। মূলত ছুটির দিনে বাবার ভ্যানটি চালিয়ে রোজগার করতো শাহিন। ভ্যানটি থেকে উপার্জিত টাকা দিয়েই চলতো তাদের সংসার। তবে সেই ভ্যানটি যে শাহিনকে মৃত্যুর মুখে নিয়ে ফেলবে কে জানতো।
গত ২৮ জুন পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে একদল সংঘবদ্ধ চক্র ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত টাকার প্রলোভন দেখিয়ে শাহিনের ভ্যানটি ভাড়া করে। ওই দিন দুপুরের দিকে ধানদিয়া এলাকায় ভ্যানচালক শাহিনের ভ্যানটি ছিনতাই করার চেষ্টা করে তারা। ভ্যানটি না ছাড়লে শাহিনের মাথা ভ্যানের লোহার সঙ্গে থেতলে দেয়। একপর্যায়ে মৃত ভেবে শাহিনকে ফেলে দেয় একটি পাটক্ষেতে।
কেশবপুর উপজেলার মঙ্গলকোট গ্রামের হায়দার আলীর ছেলে শাহিন অজ্ঞান হয়ে পাটক্ষেতেই পড়ে থাকে এক ঘণ্টারও বেশি সময়। এরপর তার জ্ঞান ফিরলে চিৎকার শুরু করে সে। ঘটনাটি স্থানীয়দের দৃষ্টিতে আসলে রক্তাক্ত অবস্থায় শাহিনকে উদ্ধার করে পাটকেলঘাটা থানা পুলিশে খবর দেয়া হয়। পরবর্তীতে থানা পুলিশ শাহিনকে উদ্ধার করে প্রথমে সদর হাসপাতাল ও পরবর্তীতে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।
শাহিনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় পরদিন (২৯ জুন) শাহিনকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠনো হয়।
শিশু শাহিনের সে সময়ের সেই রক্তাক্ত ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে হৃদয় নাড়া দিয়ে যায় প্রত্যেক বিবেকবান মানুষদের। তোলপাড় শুরু হয় মিডিয়া পাড়ায়। শিশু শাহিনের ওপর নৃশংসভাবে হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ প্রশাসনও নড়েচড়ে বসে। শাহিনের বাবা হায়দার আলী মোড়ল ২৯ জুন সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা থানায় অজ্ঞাতনামা তিনজনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।
এরই মধ্যে শিশু শাহিনের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মামলায় শাহিনের বাবা উল্লেখ করেন, শুকনা ঝাল পোড়া দিয়ে ভাত খেয়ে শাহিন ভ্যানটি নিয়ে বাইরে যায়। যাওয়ার সময় বলে যায় সাড়ে তিনশ টাকা ভাড়া আছে। মাদরাসা ছুটির দিনে ভ্যানটি চালাতো শাহিন। এরপর লোক মারফত জানতে পারি রক্তাক্ত অবস্থায় শাহিনকে ধানদিয়া এলাকায় পাওয়া গেছে। ত্রিশ হাজার টাকা মূল্যের একটি ভ্যান গাড়ি নিয়ে পালিয়েছে দুর্বত্তরা।
মামলার ওপর ভিত্তি করেই সাতক্ষীরার তৎকালীন পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমানের নির্দেশে ঘটনার তদন্ত ও জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু করে সাতক্ষীরা ডিবি পুলিশ। ডিবি পুলিশের তৎকালীন ওসি আলী আহম্মেদ হাশেমীর নেতৃত্বে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিন আসামিকে গ্রেফতার ও ছিনতাই হওয়া ভ্যানটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয় ডিবি পুলিশের টিম। উন্মোচিত হয় নৃশংস এ হামলার প্রকৃত মোটিভ।
সাতক্ষীরা ডিবি পুলিশের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী আহম্মেদ হাশেমী জানান, তৎকালীন পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমানের নির্দেশে একযোগে কাজ করেছে সাতক্ষীরা ডিবি পুলিশ। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ঘটনার প্রধান আসামি কেশবপুর উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের বাবর আলী মোড়লের ছেলে নাইমুল ইসলাম নাইমকে (২৪) গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় ছিনতাই হওয়া শাহিনের সেই ভ্যানটিও। একই সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় ভ্যানটির চারটি ব্যাটারির ক্রেতা সাতক্ষীরা সদর উপজেলার গোবিন্দকাটি গ্রামের মৃত হামজের আলীর ছেলে বাকের আলী (৪৫) ও ভ্যান ক্রেতা সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার আলাইপুর গ্রামের মৃত ধোলাই পাড়ের ছেলে আরশাদ পাড় অরফে নুনু মিস্ত্রিকে (৬৫)।
তিনি আরও জানান, গ্রেফতাররা জিজ্ঞাসাবাদে ছিনতাইয়ের রহস্য জানান। একই সঙ্গে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেন। তাদের স্বীকারোক্তি মতে ঘটনায় জড়িত অপর তিনজনকেও অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় ভ্যান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা ও নৃশংস এ হামলায় জড়িত থাকা কেশবপুর উপজেলার সরফাবাদ গ্রামের জাহাঙ্গীর মোড়ল (২৬), একই গ্রামের মৃত জহর আলী মোড়লের ছেলে নরিম মোড়ল (৬০) ও একই উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের শওকত আলীর ছেলে আজগর আলীকে (৩০)।
‘গ্রেফতাররা এ হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও প্রদান করে। ডিবি পুলিশের প্রত্যেকটি সদস্য একযোগে কাজ করেছে ঘটনার রহস্য উন্মোচনে যার ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই ঘটনাটির রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়।’
ওসি জানান, এ ঘটনার তদন্ত শেষ হয়েছে অনেক আগেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শাহিনের মেডিকেল রিপোর্ট চাওয়া হয়েছিল। মেডিকেল রিপোর্টের পর চার্জশিট জমা হবে আদালতে।
এদিকে, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা শাহীন ৮০ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে কেশবপুর উপজেলার মঙ্গলকোট গ্রামে নিজ বাড়িতে ফেরে।
মাদরাসা ছাত্র ভ্যানচালক শাহিন বলছিল , আমি এখন সুস্থ আছি। চলাফেরা করতে পারছি। বাইরে খুববেশি যাই না, ভয় লাগে। তাই বাড়িতেই থাকি।
অন্যদিকে, শাহিনের দাদা আফসার আলী বলেন, শাহিন এখন অনেক সুস্থ। মাথার ক্ষত জায়গাটা এখনও শুকায়নি। কয়েকদিনের মধ্যেই শুকিয়ে যাবে। শাহিনের ক্ষতটা শুকিয়ে গেলে শাহিনকে নিয়ে আমরা সাতক্ষীরা ও পাটকেলঘাটায় নিয়ে ঘুরে আসব। যারা শাহিনকে বাঁচাতে সহযোগিতা করেছে, তাদের সঙ্গে দেখা করব। তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
বাংলা৭১নিউজ/জেএইচ