প্রিয়জনের প্রতি আপনার ভালোবাসা যতই গভীর হোক না কেন, মৃত্যুর পর তার সঙ্গে থাকা অসম্ভব। মৃত ব্যক্তি একাই রয়ে যান অন্ধকার গহ্বরে। অনেকেই ভালোবেসে বলেন, বাঁচব একসঙ্গে আর মরবও একসঙ্গে। তবে একসঙ্গে বাঁচলেও ক’জনের ভাগ্য হয় একসঙ্গে মরার!
সম্প্রতি উত্তর চীনে দু’জনের আলিঙ্গনরত সমাহিত কঙ্কাল পাওয়া গেছে। গবেষকদের তথ্য মতে, এই প্রেমিক যুগলের সমাধি প্রায় ১৫০০ বছর পুরোনো। সমাধিতে পাওয়া নারী কঙ্কালের বাম হাতের আঙুল থেকে উদ্ধার করা হয় একটি রুপার আংটি। এই নারী সম্ভবত তার স্বামীর মৃত্যুর পর আত্মহত্যা করেছিলেন, যাতে স্বামীর সঙ্গে তার সমাধি হয়।
গবেষকরা ধারণা করেন, পুরুষ কঙ্কালটি স্বাভাবিকভাবেই মারা গিয়েছিলেন। স্ত্রী তার স্বামীর মৃত্যুতে এতোটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে, সহমরণে যান। স্বামীকে ছাড়া তিনি বেঁচে থাকতে চাননি। তাই তো স্বামীর কবরে নিজেও দাফন হয়েছিলেন এই নারী।
মরার পরেও তারা একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। যদিও চীনে যৌথ দাফনের বিষয়টি বিরল নয়। তবে এই আলিঙ্গনরত কঙ্কালের নিদর্শন সবার চোখেই জল এনে দেয়। তাদের ভালোবাসার এই নিদর্শন দৃষ্টান্তমূলক।
টেক্সাসের এ অ্যান্ড এম কলেজ অব ডেন্টিস্ট্রির বায়োমেডিকেল সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কিয়ান ওয়াং বলেন, ‘এটাই চীনে উদ্ধারপ্রাপ্ত প্রথম সমাধি, যেখানে দম্পতি আলিঙ্গনরত অবস্থায় আছে হাজারও বছর ধরে।’
ওয়াং বলেন, প্রত্নতাত্ত্বিকরা একই সমাধিস্থলে আরও দু’জন দম্পতির সমাধি পেয়েছিলেন। তবে তারা আলিঙ্গনরত অবস্থায় ছিলেন না। আবার ওই সমাধি দু’টিতে পাওয়া নারীদের আঙুলে আংটিও ছিল না।
গবেষকরা বিভিন্ন পরীক্ষা করার পর কঙ্কাল দু’টি সম্পর্কে বলেন, পুরুষটি দাঁড়ানো অবস্থায় প্রায় ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি (১৬১.৫ সেন্টিমিটার) লম্বা ছিলেন। তার শরীরে বেশ কিছু আঘাতের চিহ্ন ছিল। তার হাত ভাঙা ছিল, ডান হাতের আঙুলের একটি অংশ কাটা ও বাম পায়ের হাড়ে ছিদ্র। সম্ভবত ২৯-৩৫ বছরের মধ্যে তিনি মারা যান।
অন্যদিকে ওই নারী মারা যাওয়ার সময় মোটামুটি সুস্থ ছিলেন। তিনি দাঁড়ানো অবস্থায় প্রায় ৫ ফুট ২ ইঞ্চি (১৫৭.১ সেন্টিমিটার) লম্বা ছিলেন। তার দাঁতে কিছুটা সমস্যা ছিল। তিনি সম্ভবত ৩৫-৪০ বছর বয়সের মধ্যে মারা যান। গবেষকরা ধারণা করেন, পুরুষের চেয়ে ওই নারীর বয়স সামান্য বেশি ছিল।
যারা এই দম্পতিকে সমাধিস্থ করেছিলেন, তারা অতি যত্ন সহকারে কাজটি করেছিলেন। পুরুষটির শরীর নারীর দিকে বাঁকানো ছিল। পুরুষটির বাম হাত নারী শরীরের নিচে ছিল। তার ডান হাত নারীর কোমড় জড়িয়ে ধরা অবস্থায় ছিল।
দেখলে মনে হবে, নারী সঙ্গী তার প্রিয়জনের বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছেন। আর পুরুষ সঙ্গী তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। গবেষকরা জানান, ‘এখানে স্বামী-স্ত্রী দু’জন একে অপরকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে পরকালীন জীবনের চিরন্তন প্রেমের বার্তা দিয়ে গেছেন।’
২০২০ সালের জুন মাসে, শানসি প্রদেশে নির্মাণ কাজ করার সময় এ সমাধিটি উদ্ধার করেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। সমাধিস্থলে প্রায় ৬০০ সমাধি ছিল। সমাধিস্থল থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তৈজসপত্র থেকে ধারণা করা হয়, তারা শিয়ানবেই নামক যাযাবর গোষ্ঠী ছিল। ৩৮৬-৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে ওয়ে রাজবংশের শাসনকালে তারা বসবাস করত। ওই সময়টা রাজনৈতিকভাবে বেশ অশান্ত।
জিয়ামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের একজন সহযোগী অধ্যাপক কুন ঝাং, যিনি এই গবেষণাপত্রের সহ-লেখক। তিনি বলেন, ওই সময় বৌদ্ধধর্ম জনপ্রিয় ছিল। এ কারণে মানুষের মধ্যে পরকালীন ধারণাগুলো বৃদ্ধি পেয়েছিল।
কেন এই দম্পতিকে একসঙ্গে সমাহিত করা হয় সে বিষয়ে গবেষকরা সঠিক তথ্য জানতে পারেননি। গবেষকদের ধারণা, প্রথম সহস্রাব্দের সময় যখন এই দম্পতি বেঁচেছিলেন, তখন চীনে অনেক কাল্পনিক প্রেমের গল্প ছিল। এমনকি অনেক ঐতিহাসিক রেকর্ড ছিল, যেখানে মানুষ ভালোবাসার জন্য জীবন দিয়েছিল।
এসব তথ্যে প্রভাবিত হয়েই হয়তো ওই নারী তার স্বামীর জন্য জীবন দেন। পরবর্তীতে তাদেরকে একসঙ্গে সমাহিত করা হয়। ১৫০০ বছরের পুরোনো সমাধি থেকে উদ্ধার করা দম্পতির কঙ্কাল পরবর্তীতে গবেষকরা জাদুঘরে রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
সূত্র: লাইভসায়েন্স
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ