বাংলা৭১নিউজ, শামছুর রহমান শিশির, শাহজাদপুর প্রতিনিধি: ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুরের সেই ছোট নদী (খোনকারের জোলা) শুকিয়ে যাওয়ায় এখন সেখানে আর ভাসে না কোনো সোনার তরী। খোনকারের জোলার মতোই একসময়ের প্রমত্তা ও স্রোতস্বিনী যমুনা, করতোয়া, বড়াল, হুরাসাগর, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুর, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোটযমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাইসহ উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় নদীবে মাইলের পর মাইল শুধু ধু-ধু বালুচর। এক সময়ের প্রমত্তা এসব নদী আজ মিনি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারে উত্তরাঞ্চলের বৃহৎ নদনদীতে এখন পর্যাপ্ত পানি নেই। আর শাখানদীগুলোর অবস্থা আরো করুণ। একেবারে মরে শুকিয়ে যাওয়ায় অনেক নদীর বুকে রোপণ করা হয়েছে ইরি-বোরো ধান। ভূগর্ভের পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে নেমে গেছে। ফলে এ অঞ্চলের গভীর ও অগভীর নলকূপ দিয়ে চলতি ইরি-বোরো ধানের সেচ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত নদনদীগুলোর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করে দেয়ায় সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ ক্রমেই মরু অঞ্চলে পরিণত হতে চলেছে। উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নদীগুলো অবস্থান করায় মরুকরণের কু-প্রভাব এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশকে করছে ভারসাম্যহীন। এসব কারণে এ অঞ্চলের নদীগুলোর গতি-প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটছে। আমরা হারাতে বসেছি আমাদের অনেক গ্রামীণ ঐতিহ্য। গ্রামীণ জনপদের মানুষের প্রিয় দেশী মাছ এখন সোনার হরিণের মতো। এখন আর দেখা যায় না গ্রামীণ ঐতিহ্যের নৌকাবাইচ, খরা জাল, সুতি ফাঁদ, সেচের মাধ্যম দাঁড়। মৎস্যভাণ্ডার সঙ্কুচিত হওয়ায় মৎস্যজীবী পরিবারগুলোয় হাহাকার। অনেকেই অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ১৯৫৪ ও ১৯৫৫ সালের ভয়াবহ বন্যার পর খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে জাতিসঙ্ঘের অধীনে ক্রুগ মিশনের সুপারিশক্রমে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপ (ইপিওয়াপদা) গঠন করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ইপিওয়াপদার পানি উইং হিসেবে দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কৃষি ও মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রধান সংস্থা হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৫৯ মোতাবেক ওয়াপদার পানি অংশ বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) নামে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর পর্যায়ক্রমে সংস্কার ও পুনর্গঠনের ধারাবাহিকতায় জাতীয় পানি নীতি-১৯৯৯ ও জাতীয় পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা-২০০৪ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাপাউবো আইন-২০০০ প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের আওতায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট পানি পরিষদের মাধ্যমে বোর্ডের শীর্ষ নীতিনির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতের মরুকরণ প্রক্রিয়ার ফলে শুষ্ক মওসুমে পদ্মা, যমুনা, করতোয়া, বড়াল, হুরাসাগর, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুর, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোট যমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাইসহ উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। ভূগর্ভের পানির স্তর অতীতের চেয়ে ও স্বাভাবিক স্তরের চেয়ে উদ্বেগজনক হারে নিচে নেমে যাওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি শাখানদী, খাল-বিল শুকিয়ে চার দিকে পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। এসব নদনদী তীরবর্তী অঞ্চলের গভীর-অগভীর নলকূপ থেকে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে মারাত্মক বিরূপ নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। নদী নির্ভর এ অঞ্চলে ভূগর্ভের পানির অপরিকল্পিত ও অতিমাত্রায় ব্যবহার এবং সেচকাজে পানির অপচয় রোধ করা না গেলে বাংলাদেশ এক মহাসঙ্কটের মুখোমুখি হবে বলে বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ার করেছেন। এ অঞ্চলের একসময়ের উত্তাল অনেক নদী ও শাখানদী বে এক ফোঁটাও পানি আর দেখা যাচ্ছে না। করতোয়ার পরিণতিও একই। নদীপথের নাব্যতা সঙ্কট ও প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজ করায় উত্তরাঞ্চলের নদী থেকে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ হ্ননিশ্চিহ্নের পথে। এসব কারণে এ অঞ্চলের নদীনির্ভর কৃষক ও এলাকাবাসীর বুকভরা আশা ক্রমেই হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। এ ছাড়া এসব নদীতে প্রয়োজনীয় পানি না থাকায় এক দিকে যেমন নৌচলাচল মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে, অন্য দিকে জাতীয় অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলতি হচ্ছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, স্রোতস্বিনী যমুনা, পদ্মা, করতোয়া, বড়াল, হুরাসাগর, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুর, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোট যমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাইসহ উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো এবং এর বেশ ক’টি শাখানদী ও খাল-বিল শুকিয়ে গেছে। ফলে নদনদীবিধৌত উত্তরাঞ্চলবাসীর শুরু হয়েছে দুঃখ-দুর্দশা। প্রকৃতিনির্ভর কৃষিপ্রধান এ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা হয়ে যাচ্ছে মিনি মরুভূমি। দুই চোখ যে দিকে যায় সে দিকেই দেখা যায় ধু-ধু বালুচর। কৃষিপ্রধান দেশে বিরাজিত এ সমস্যা রোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ আর কার্যকর পদক্ষেপ সরকারকেই নিতে হবে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন।
বাংলা৭১নিউজ/জেএস