বাংলা৭১নিউজ,ডেস্ক: সাইয়েদ ইবনে তাউস বলেন, যখন ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর পরিবারের যুবকদের ও বন্ধুদের লাশ দেখতে পেলেন তখন তিনি শহীদ হওয়ার জন্য দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন এবং উচ্চ কণ্ঠে বললেন, “কেউ কি আছে আল্লাহর রাসূলের পরিবারকে রক্ষা করবে? তওহীদবাদী কেউ কি আছে যে আল্লাহকে ভয় করবে আমাদের বিষয়ে? কোন সাহায্যকারী কি আছে যে আল্লাহর জন্য আমাদেরকে সাহায্য করতে আসবে? কেউ কি আছে যে আমাদের সাহায্যে দ্রুত আসবে আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কারের বিনিময়ে?”
দুধের শিশু আব্দুল্লাহ (আলী আল আসগার)-এর শাহাদাত
নারীদের কান্নার আওয়াজ উঁচু হলো এবং ইমাম তাঁবুর দরজায় এলেন এবং বোন যায়নাবকে (আ.) ডাকলেন, “আমাকে আমার দুধের শিশুটিকে দাও যেন বিদায় নিতে পারি।” এরপর তিনি তাকে দুহাতে নিলেন এবং উপুড় হলেন তার ঠোটে চুমু দেয়ার জন্য। হুরমালা বিন কাহিল আসাদি শিশুটির দিকে একটি তীর (তিন শাখা-বিশিষ্ট) ছুঁড়লো, যা তার গলা ভেদ করে তার মাথা আলাদা করে ফেললো (আল্লাহর রহমত ও বরকত তার উপর বর্ষিত হোক এবং আল্লাহর অভিশাপ পড়ুক তার হত্যাকারীর উপর)। এরপর ইমাম তাঁর বোন সাইয়েদা যায়নাবকে (আ.)উচ্চ কণ্ঠে ডাকলেন শহীদ দুধের শিশুকে ফেরত নেয়ার জন্য। তিনি শিশুর রক্ত তাঁর হাতের তালুতে নিলেন এবং আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “প্রত্যেক কষ্টই আমার জন্য সহজ যখন আল্লাহ তা দেখছেন।”
অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, ইমাম দুধের শিশু আলী আসগরের রক্ত জমা করলেন এবং যখন তার দুহাতের তালু রক্তে পূর্ণ হলো তখন তিনি তা জমিনে ছিটিয়ে দিলেন এবং বললেন: সর্বশক্তিমান আল্লাহ, যদি আপনি আকাশ থেকে সাহায্য বন্ধ করে দিয়ে থাকেন তাহলে আমাদের উপর তা দান করুন যা এর চেয়ে ভালো এবং এই অপরাধীদের উপর আমাদের হয়ে প্রতিশোধ নিন।’’
সিবতে ইবনে জওযি তার ‘তাযকিরাহ’-তে বর্ণনা করেছেন, যখন ইমাম হুসাইন দেখলেন তারা তাঁকে হত্যা করবেই, তিনি কুরআন আনলেন এবং তা খুলে মাথার উপর রাখলেন এবং উচ্চ কণ্ঠে বললেন, “আল কুরআন এবং আমার নানা, আল্লাহর রাসূল (সা.) হলেন আমার ও তোমাদের মধ্যে বিচারক। হে জনতা, কিভাবে তোমরা আমার রক্ত ঝরানোকে বৈধ মনে করছো? আমি কি তোমাদের নবীর নাতি নই? আমার নানা থেকে কি হাদীস পৌঁছায়নি তোমাদের কাছে আমার ও আমার ভাই সম্পর্কে যে আমরা জান্নাতের যুবকদের সর্দার? যদি সন্দেহ থাকে তাহলে জিজ্ঞেস করো জাবির (বিন আব্দুল্লাহ আনসারি)-কে, যায়েদ বিন আরকামকে এবং আবু সাঈদ খুদরীকে। জাফর তাইয়ার কি আমার চাচা নন? ….”
শিমার উত্তর দিল, “খুব শীঘ্রই তুমি জ্বলন্ত আগুনের (জাহান্নামের) দিকে দ্রুত যাবে।” (আউযুবিল্লাহ)। ইমাম বললেন, “আল্লাহু আকবার, আমার নানা আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাকে জানিয়েছেন যে তিনি দেখেছেন একটি কুকুর তার গলা পূর্ণ করছে তার আহলুল বাইত (আ.) এর রক্ত দিয়ে এবং আমি বুঝতে পারছি সেটি তুমি ছাড়া কেউ নয়।”শিমার বললো, “আমি শুধু জিহ্বা দিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবো, যদি আমি বুঝি তুমি কী বলছো।” ইমাম হুসাইন (আ.) ফিরে দেখলেন তার শিশুপুত্র পিপাসায় কাঁদছে। তিনি তাকে কোলে নিলেন এবং বললেন, “হে জনতা, যদি তোমরা আমার প্রতি দয়া না দেখাও, কমপক্ষে এ বাচ্চার উপর দয়া করো।” এক ব্যক্তি একটি তীর ছুঁড়লো যা তার গলা বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। ইমাম কেঁদে বললেন, “হে আল্লাহ, আপনি বিচারক হোন আমাদের মাঝে ও তাদের মাঝে, যারা আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং এর বদলে আমাদের হত্যা করেছে।” একটি কণ্ঠ আকাশ থেকে ভেসে এলো, “তাকে ছেড়ে দাও হে হুসাইন, কারণ এক সেবিকা তাকে শুশ্রূষা করার জন্য বেহেশতে অপেক্ষা করছে।” এরপর হাসীন বিন তামীম একটি তীর ছুঁড়ে তার ঠোটের দিকে এবং তা থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে।
ইমাম কাঁদলেন এবং বললেন, “হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে অভিযোগ করি, তারা যেভাবে আমার সাথে, আমার ভাই, আমার সন্তানদের এবং আমার পরিবারের সাথে আচরণ করেছে।”
ইবনে নিমা বলেন যে, তিনি বাচ্চাটিকে তুললেন এবং তার পরিবারের শহীদদের সাথে রাখলেন।
মুহাম্মাদ বিন তালহা তার গ্রন্থ ‘মাতালিবুস সা’উল’-এ ‘ফুতূহ’ নামের গ্রন্থ থেকে উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম হুসাইন (আ.) এর একটি শিশু পুত্র ছিল, তার দিকে একটি তীর নিক্ষিপ্ত হয় যা তাকে হত্যা করে এবং এরপর ইমাম তার তরবারি দিয়ে একটি কবর খুঁড়েন তার জন্য এবং তার জন্য দোআ করে তাকে দাফন করেন।
শাহাদাতের লেখকরা এবং ইহতিজাজের লেখকও বলেন যে, ইমাম এরপর তার ঘোড়ায় চড়লেন এবং যুদ্ধের জন্য এগিয়ে গেলেন এই বলে, “এ জাতি অবিশ্বাস করেছে এবং তারা রাব্বুল আলামীনের পুরস্কার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, এ জাতি হত্যা করেছে আলীকে এবং তার সন্তান হাসানকে, যিনি ছিলেন উত্তম এবং সম্মানিত পিতা-মাতার সন্তান। তারা ঘৃণা ও বিদ্বেষে পূর্ণ ছিলো এবং তারা জনতাকে ডাক দিয়েছে এবং জমা হয়েছে হুসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। অভিশাপ এ নীচ জাতির উপর যারা বিভিন্ন দলকে একত্র করেছে ‘দুই পবিত্র আশ্রয়-স্থানের’ লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। এভাবে মুশরিকদের বংশধর উবায়দুল্লাহর জন্য তারা যাত্রা করেছে এবং মুরতাদদের আনুগত্য করার জন্য অন্যদেরকে আহ্বান করেছে আল্লাহর বিরোধিতা করে আমার রক্ত ঝরানোর জন্য, এবং সা’আদের সন্তান আমাকে হত্যা করেছে আক্রমণাত্মকভাবে এক সেনাবাহিনীর সাহায্যে যা প্রবল প্লাবনের মত এবং এ সব আমার কোন অপরাধের প্রতিশোধের জন্য নয়, শুধু এ কারণে যে, আমার গর্ব হচ্ছে আমি দুই নক্ষত্রের (একজন), আলী যিনি ছিলেন নবীর পরে শ্রেষ্ঠ এবং (আমার নানা) নবী ছিলেন কুরাইশ পিতা- মাতার সন্তান, আমার বাবা মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং আমি দুজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সন্তান, রূপার মত যা বেরিয়ে এসেছে স্বর্ণ থেকে, আমি হচ্ছি রূপা, দুই স্বর্ণালীর সন্তান, আর কারো নানা কি আমার নানার মত, অথবা তাদের পিতা আমার পিতার মত, এরপর আমি দুজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির পুত্র সন্তান, আমার মা ফাতিমাতুয যাহরা এবং বাবা যিনি মুশরিকদের পিঠ ভেঙ্গে দিয়েছিলেন বদর ও হুনাইনের যুদ্ধে এবং যিনি শৈশবকাল থেকেই রবের ইবাদত করেছেন যখন কুরাইশরা ইবাদত করতো একসাথে দুই মূর্তি- লাত ও উযযার, তখন আমার বাবা নামায পড়েছেন দুই কিবলার দিকে ফিরে। আর আমার বাবা হলেন সূর্য এবং আমার মা চাঁদ, আর আমি এক নক্ষত্র, দুই চাঁদের সন্তান এবং তিনি (আলী) উহুদের দিনে এমন মোজেযা দেখিয়েছেন সেনাবাহিনীকে দুভাগ করে দেয়ার মাধ্যমে, যা হিংসা দুর করেছিলো এবং আহযাবে (এর যুদ্ধে) ও মক্কা বিজয়ে। যেদিন দুই সেনাবাহিনীতে একটি কথাই ছিলো – মৃত্যু এবং এ সবই আল্লাহর রাস্তায় করা হয়েছিলো, কিন্তু কিভাবে এই নীচ জাতি এ দুই সন্তানের সাথে আচরণ করেছে – যারা সৎকর্মশীল নবী ও আলীর সন্তান, দুই সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের দিনে যারা লাল গোলাপের মত।”
এরপর তিনি সেনাবাহিনীর দিকে ফিরে দাঁড়ালেন তাঁর তরবারি খাপমুক্ত করে, জীবনকে পরিত্যাগ করে এবং হৃদয়ে মৃত্যুর দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে। তিনি বলছিলেন, “আমি আলীর সন্তান, যিনি ছিলেন পবিত্র ও হাশিমের বংশধর এবং এ মর্যাদা আমার জন্য যথেষ্ট যখন আমি গর্ব করি, আমার নানা আল্লাহর রাসূল সবার চেয়ে সম্মানিত। আমরা সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর বাতি এবং আমার মা ফাতিমা যাহরা (আ.), যিনি আহমাদ (সা.) এর কন্যা এবং আমার চাচা (হযরত জাফর) যিনি দুপাখার অধিকারী বলে পরিচিত এবং আমাদের মাঝে আছে আল্লাহর কিতাব এবং তা সত্যসহ নাযিল হয়েছে এবং আমাদের মধ্যেই আছে বৈধতা এবং কল্যাণপূর্ণ ওহী এবং আমরা হলাম সব মানুষের মধ্যে আল্লাহর আমানত এবং আমরা গোপনে ও প্রকাশ্যে ঘোষণা করি যে কাউসারের উপর আমরা কর্তৃত্ব রাখি এবং আমরা আমাদের অনুসারীদের পান করাবো নবীর পেয়ালা দিয়ে, যা অস্বীকার করা যায় না এবং আমাদের অনুসারীরা হলো অনুসারীদের মধ্যে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং যারা আমাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করে কিয়ামতের দিন তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।”
মুহাম্মাদ বিন আবু তালিব বলেন আবু আলী সালামি তার ইতিহাসে বর্ণনা করেছেন যে, এ শোকগাথাটি ইমাম হুসাইন (আ.) এর নিজের সৃষ্টি এবং এর মত কোন শোকগাথা নেই:
“যদিও এ পৃথিবীকে প্রীতিকর মনে করা হয়, আল্লাহর পুরস্কার হচ্ছে সুমহান ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এবং যদি দেহকে তৈরি করা হয়ে থাকে মৃত্যুর জন্য তাহলে আল্লাহর পথে শহীদ হওয়া মানুষের জন্য সবচেয়ে ভালো এবং যদি রিযক বিতরণ করা হয় ও নিশ্চয়তা থাকে তাহলে মানুষের উচিত না তা অর্জনের জন্য কঠিন চেষ্টা করা এবং যদি এ সম্পদ জমা করার ফলাফল হয় তা পেছনে ফেলে যাওয়া, তাহলে কেন মানুষ লোভী হবে?” এরপর তিনি সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন এবং যে-ই কাছে এলো তৎক্ষণাৎ নিহত হলো এবং লাশের স্তূপ জমা হলো। এরপর তিনি সেনাবাহিনীর ডান অংশকে আক্রমণ করলেন এবং বললেন, “অপমান হওয়া মৃত্যুর চাইতে উত্তম এবং অপমান জাহান্নামের আগুনে প্রবেশের চাইতে উত্তম।”
এরপর তিনি সেনাবাহিনীর বাম অংশকে আক্রমণ করলেন এবং বললেন, “আমি হুসাইন, আলীর সন্তান, আমি শপথ করেছি যে শত্রুদের কাছ থেকে পালিয়ে যাবো না এবং আমার বাবার পরিবারকে রক্ষা করবো, যতক্ষণ না আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ধর্মের উপর নিহত হই।”কিছু বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর শপথ, আমি তাঁর মত কোন বীর দেখিনি, যে তার সন্তান, পরিবার ও বন্ধুদের হারিয়ে ভেঙ্গে গেছে। যোদ্ধারা তার ওপরে প্রথমে আক্রমণ চালালো এবং তিনিও তাদের আক্রমণের সমান জবাব দিলেন এবং তিনি তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলেন যেভাবে নেকড়ে ভেড়ার সারিতে ঢুকে পড়ে এবং তাদের তিনি বিতাড়িত করলেন এবং পঙ্গপালের মত ছত্রভঙ্গ করে দিলেন। তিনি অস্ত্রে সুসজ্জিত ত্রিশ হাজার সৈন্যের বাহিনীকে আক্রমণ করলেন এবং তারা তার সামনে পঙ্গপালের মত ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। এরপর তিনি তার জায়গায় ফেরত এলেন এবং বললেন, “কোন ক্ষমতা নেই ও কোন শক্তি নেই শুধু আল্লাহর কাছে ছাড়া যিনি উচ্চ ও মহান।”‘ইসবাত আল ওয়াসিয়াহ’তে বর্ণিত আছে যে তিনি নিজ হাতে আঠারো শত যোদ্ধাকে হত্যা করেন।
‘বিহারুল আনওয়ার’-এ আছে যে, ইবনে শাহর আশোব এবং মুহাম্মাদ বিন আবি তালিব বলেছেন যে, তিনি অবিরাম আক্রমণ করলেন যতক্ষণ না তিনি উনিশশত পঞ্চাশ ব্যক্তিকে হত্যা করলেন, আহতদের সংখ্যা ছাড়াই। উমর বিন সা’আদ সেনাবাহিনীকে উচ্চ কণ্ঠে বললো, “আক্ষেপ তোমাদের জন্য, তোমরা জানো তোমরা কার সাথে যুদ্ধ করছো? … সে হচ্ছে আরবদের ঘাতকের (আলীর) সন্তান। তাকে সব দিক থেকে আক্রমণ করো।” চার হাজার তীরন্দাজ তাকে ঘেরাও করে ফেললো এবং তাঁবুর দিকে যাওয়ার পথ বন্ধ করে দিলো।
মুহাম্মাদ বিন আবি তালিব, ইবনে শাহর আশোব এবং সাইয়েদ ইবনে তাউস বলেন যে, ইমাম হুসাইন (আ.) তখন বললেন, “দুর্ভোগ তোমাদের উপর হে আবু সুফিয়ানের পরিবারের অনুসারীরা, যদি তোমরা অধার্মিক লোক হও এবং কিয়ামতের দিনটিকে ভয় না পাও তাহলে কমপক্ষে স্বাধীন চিন্তার লোক হও এবং বুঝতে চেষ্টা করো যদি তোমরা আরবদের বংশধর হও।”
শিমার বললো, “হে ফাতিমার সন্তান, তুমি কী বুঝাতে চাও?”ইমাম বললেন, “আমি বলছি যে আমরা পরস্পর যুদ্ধ করবো কিন্তু নারীরা তো কোন দোষ করে নি। আমার পরিবারের তাঁবু লুট করা থেকে বিরত থাকো যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি।”শিমার বললো, “নিশ্চয়ই তোমার অধিকার আছে।” তখন সে উচ্চ কণ্ঠে ডাকলো, “তাঁবুগুলো থেকে ফেরত আসো এবং তাকে তোমাদের লক্ষ্যে পরিণত করো এবং সে দয়ালু সমকক্ষ।” তখন পুরো সেনাবাহিনী তার দিকে ফিরলো এবং ইমাম হুসাইন (আ.) পানি পান করতে চাইলেন। যখনই তিনি ফোরাত নদীর দিকে যেতে চাইলেন, সেনাবাহিনী তাকে আক্রমণ করলো এবং নদী থেকে ফিরিয়ে দিলো।
ইবনে শাহর আশোব বলেন যে, ইমাম হুসাইন (আ.) আক্রমণ করেন আ’ওয়ার সালামি ও আমর বিন হাজ্জাজ যুবাইদিকে যারা চার হাজার সৈন্যসহ ফোরাত নদীর তীর পাহারা দেয়ার জন্য নিয়োজিত ছিলো। তখন তিনি তার ঘোড়াকে নদীতে প্রবেশ করালেন এবং যখন ঘোড়া তার মুখ পানিতে রাখলো পান করার জন্য ইমাম বললেন, “হে আমার ঘোড়া, তুমি তৃষ্ণার্ত এবং আমিও এবং যতক্ষণ না তুমি পান করো আমি আমার তৃষ্ণা মিটাবো না।” যখন ঘোড়াটি ইমামের এ কথাগুলি শুনলো সে তার মাথা তুলে ফেললো এবং পানি খেলো না, যেন সে বুঝতে পেরেছে ইমাম কী বলেছেন। ইমাম বললেন, “আমি পান করবো এবং তুমিও পান করো।” তিনি তার হাত লম্বা করে দিলেন এবং হাতের তালু পানিতে পূর্ণ করলেন। তখন সেনাবাহিনীর এক ব্যক্তি চিৎকার করে বললো, “হে আবা আব্দিল্লাহ, তুমি শান্তিতে পানি পান করছো অথচ তোমার তাঁবুগুলো লুট করা হচ্ছে?” তা শুনে ইমাম পানি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন এবং আক্রমণ করলেন। তিনি শত্রুবাহিনীকে দুভাগ করে এগিয়ে দেখতে পেলেন তার তাঁবুগুলি নিরাপদ আছে।
আল্লামা মাজলিসি তার ‘জালাউল উয়ুন’-এ বলেছেন যে, আবারও তিনি তার পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিলেন এবং তাদেরকে সহনশীল হওয়ার আদেশ করলেন এবং তাদেরকে পুরস্কার ও প্রতিদানের শপথ করলেন, এরপর বললেন, “তোমাদের চাদরগুলো পরো, পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও এবং জেনে রাখো আল্লাহ তোমাদের সাহায্য ও নিরাপত্তা দানকারী এবং তোমাদেরকে শত্রুদের খারাপ আচরণ থেকে মুক্তি দিবেন এবং তোমাদের উত্তম পরিসমাপ্তি ঘটাবেন। তার ক্রোধ তোমাদের শত্রুদের ঢেকে ফেলবে বিভিন্ন দুর্যোগে এবং তিনি তোমাদের উপর বিশেষ বরকত ও আশ্চর্যজনক উপহার দিবেন এ পরীক্ষার পরে। অভিযোগ করো না, এমন কিছু বলো না যা তোমাদের মর্যাদা কমিয়ে দেয়।”
‘বিহারুল আনওয়ার’-এ আছে যে আবুল ফারাজ বলেছেন যে, ইমাম হুসাইন (আ.) নদীর দিকে গেলেন এবং শিমার বললো, “তুমি নদীর দিকে যাবে না, বরং তুমি আগুনের দিকে যাবে।” (আউযুবিল্লাহ)। এক ব্যক্তি উচ্চ কণ্ঠে বললো, “ও হুসাইন, তুমি কি দেখছো না মাছের পেটের মত ফোরাত নড়াচড়া করছে? আল্লাহর শপথ, তুমি অবশ্যই এর স্বাদ পাবে না যতক্ষণ না তৃষ্ণায় মারা যাও।” ইমাম বললেন, “ইয়া রব, তাকে তৃষ্ণার কারণে মৃত্যু দাও।” বর্ণনাকারী বলে যে (ওই) ব্যক্তি বলতো, “আমাকে পান করার জন্য পানি দাও।” তাকে পানি দিলে সে তা থেকে পান করতো এবং বমি করে ফেলতো। আবারও সে বলতো, “আমাকে পান করার জন্য পানি দাও কারণ তৃষ্ণা আমাকে মেরে ফেলছে।” এ রকম চলতে থাকলো যতক্ষণ না সে মৃত্যুমুখে পতিত হলো (আল্লাহর অভিশাপ তার উপর)।
আবু হাতূফ নামে এক ব্যক্তি একটি তীর ছুঁড়ে ইমাম হুসাইনের (আ.)দিকে যা তার কপালে বিদ্ধ হয়। তিনি তা টেনে বের করলেন এবং রক্ত তাঁর চেহারা ও দাড়ি ভিজিয়ে দিলো। তখন তিনি বললেন, “হে আমার রব, আপনি কি দেখছেন এ খারাপ লোকদের হাতে আমাকে কী সহ্য করতে হচ্ছে? ইয়া রব, তাদের সংখ্যা কমিয়ে দিন এবং তাদের শেষটিকেও হত্যা করুন এবং তাদের একটিকেও পৃথিবীর উপর রাখবেন না এবং তাদের ক্ষমা করবেন না।”
এরপর তিনি তাদের আক্রমণ করলেন এক ভয়ঙ্কর সিংহের মত এবং কেউ ছিলো না যে তাঁর কাছে পৌঁছতে পারে, তিনি তাদের পেট কেটে হত্যা করলেন। তারা সব দিক থেকে তাকে তীর ছুঁড়তে লাগলো যেগুলোর আঘাত তিনি বুকে ও ঘাড়ে নিলেন এবং বললেন, “কত খারাপ আচরণই না তোমরা করলে মুহাম্মাদ (সা.) এর বংশধরদের সাথে তাঁর মৃত্যুর পর। আমাকে হত্যা করার পর তোমরা আল্লাহর কোন বান্দাহকে হত্যা করতে আর ভয় পাবে না এবং আমাকে হত্যা করা তোমাদের কাছে তাদের হত্যাকে সহজ করে দিবে। আমি আল্লাহর কাছে আশা করি যে তিনি তোমাদের হাতে আমাকে অপমানের বদলে আমাকে শাহাদাত দান করবেন এবং এরপর আমার প্রতিশোধ নিবেন এমন মাধ্যমে যে তোমরা তা কখনো চিন্তাও করতে পারবেনা।”
এ কথাগুলো শুনে হাসীন বিন মালিক সাকনি বল লো, “হে ফাতিমার সন্তান, কিভাবে আল্লাহ আমাদের উপর তোমার প্রতিশোধ নিবেন?” ইমাম বললেন, “তিনি তোমাদের যুদ্ধে ঢেকে ফেলবেন এবং তোমাদের রক্ত ঝরাবেন, এরপর এক ভয়ানক শাস্তি তোমাদের উপর আসবে।” এরপর তিনি যুদ্ধ করলেন যতক্ষণ না অনেক আঘাতে জর্জরিত হলেন। ইবনে শাহর আশোব ও সাইয়েদ ইবনে তাউস বলেন আঘাতের সংখ্যা ছিলো বাহাত্তর।
ইবনে শহর আশোব আবু মাখনাফ থেকে তিনি ইমাম জাফর আস সাদিক্ব (আ.) থেকে বর্ণনা করেন যে, “ইমাম হুসাইন (আ.) এর শরীরে বর্শার তেত্রিশটি আঘাত ও তরবারির চৌত্রিশটি আঘাত ছিলো।”ইমাম মুহাম্মাদ আল বাক্বির (আ.) বলেন যে, “ইমাম হুসাইন (আ.) বর্শা, তরবারি ও তিনশ বিশটির বেশী তীর থেকে আঘাত পেয়েছিলেন।”তীর তার বর্ম ভেদ করে সজারুর কাটার মত এবং বর্ণনা করা হয় যে তার সব আঘাত ছিলো দেহের সামনের দিকে।
বর্ণিত আছে যে (অতিরিক্ত) যুদ্ধ ইমাম হুসাইন (আ.) কে ক্লান্ত করে ফেলে এবং তিনি বিশ্রাম নেয়ার জন্য খানিক ক্ষণের জন্য থামেন। সে সময় একটি পাথর তার কপালে নিক্ষিপ্ত হয় এবং তিনি তার জামার সামনের দিক উঁচু করলেন তা (রক্ত) মোছার জন্য। তখন বিষ মাখানো তিন মাথার একটি তীর তার বুক ভেদ করলো। কিছু বর্ণনায় আছে যে, তা তার হৃৎপিণ্ড ভেদ করলো এবং এ সময় তিনি বললেন, “আল্লাহর নামে এবং আল্লাহর সাহায্যে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বিশ্বাসের ওপরে।” এরপর তিনি তাঁর মাথা আকাশের দিকে তুললেন এবং বললেন, “হে আল্লাহ, তুমি জানো তারা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকে হত্যা করতে যে ছাড়া পৃথিবীতে নবীর আর কোন সন্তান নেই।” এরপর তিনি তীরটি টেনে বের করলেন তার (বুক অথবা) পিঠ থেকে এবং রক্ত প্রবাহিত হলো ছোট্ট একটি নদীর মত। তিনি তা দিয়ে তার হাতের তালু ভরে ফেললেন এবং তা আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলেন এবং একটি ফোটাও তা থেকে মাটিতে ফিরে এলো না। এরপর তিনি তার অন্য হাতের তালু রক্তে ভরে ফেললেন এবং তা মাথায় ও দাড়িতে মাখলেন এবং বললেন, “আমি চাই আমার নানা আল্লাহর রাসূল (সা.) এর সাথে আমার রক্তে রঙ্গিন হয়ে মিলিত হতে এবং আমি বলবো, হে রাসূলুল্লাহ, অমুক অমুক ব্যক্তি আমাকে হত্যা করেছে।”
শেইখ মুফীদ ইমাম হুসাইন (আ.) এর ঘোড়ায় চড়া ও ফোরাত নদীর তীরের দিকে যাওয়া এবং তার ভাই আব্বাস (আ.) এর শাহাদাত বর্ণনা করার পর বলেন যে, ইমাম হুসাইন (আ.) ফোরাত থেকে ফিরে তার তাঁবুর দিকে আসেন। শিমার বিন যিলজাওশান, তার কিছু সহযোগী নিয়ে তার কাছে এলো এবং তাকে সব দিক থেকে ঘেরাও করে ফেললো। মালিক বিন বিশর কিনদি নামে এক ব্যক্তি এগিয়ে এসে ইমাম হুসাইনকে (আ.)গালাগালি করতে লাগলো এবং তার তরবারি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করলো। তা তার রাতে পরর টুপি কেটে মাথায় পৌঁছে গেলো এবং রক্ত প্রবাহিত হতে শুরু করলো এবং টুপিটি ভরে ফেললো। ইমাম হুসাইন (আ.) বললেন, “তুমি এ হাত দিয়ে আর কখনো খাবে না ও পান করবে না এবং তুমি উঠে দাঁড়াবে (কিয়ামতের দিন) অত্যাচারীদের সাথে।” তিনি মাথা থেকে টুপিটি সরালেন এবং একটি রুমাল চেয়ে তা দিয়ে মাথা বাঁধলেন। এরপর তিনি আরেকটি টুপি পরলেন এবং তার উপর একটি পাগড়ী বাঁধলেন।
তাবারি বলেন যে, আবু মাখনাফ বর্ণনা করেছে, শিমার দশ জন কুফী পদাতিক সৈন্যকে একত্র করলো এবং ইমাম হুসাইন (আ.) এর নারীদের তাঁবুগুলোর দিকে অগ্রসর হলো এবং ইমাম ও তাঁর পরিবারের মাঝখানে অবস্থান গ্রহণ করলো। ইমাম হুসাইন (আ.) বললেন, “দুর্ভোগ তোমাদের উপর, যদি তোমরা ধর্মহীন মানুষ হয়ে থাকো এবং ফেরত যাওয়ার দিনকে (কিয়ামতকে) ভয় না পাও, কমপক্ষে তোমাদের পৃথিবীতে স্বাধীন চিন্তা-সম্পন্ন এবং মর্যাদাবান লোক হও। তোমরা আমার পরিবারের কাছ থেকে অসভ্য ও নির্বোধ লোকদের দূরে রাখো।” শিমার বললো, “হে ফাতিমার সন্তান, নিশ্চয়ই তোমার অধিকার আছে।” এরপর সে তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে ইমাম হুসাইন (আ.) এর দিকে অগ্রসর হলো। তাদের মাঝে ছিলো আবুল জুনুব আব্দুর রহমান জু’ফি, ক্বাশ’আম বিন আমর বিন ইয়াযীদ জু’ফি, সালেহ বিন ওয়াহাব ইয়াযবী, সিনান বিন আনাস নাখাই এবং খাত্তলি বিন ইয়াযীদ আসবাহি। শিমার তাদের উস্কানি দিলো ইমাম হুসাইন (আ.) কে হত্যা করার জন্য।
বর্ণনায় আছে যে শিমার , সঙ্গে দশ জন পদাতিক সৈন্য নিয়ে, ইমাম হুসাইন (আ.) এর দিকে ফিরলো এবং তিনি তাদেরকে আক্রমণ করলেন ও ছত্রভঙ্গ করে দিলেন। তখন তারা তাকে আরও কঠিনভাবে ঘেরাও করলো। সে মুহূর্তে একটি শিশু ইমাম হুসাইন (আ.) এর দিকে ছুটে এলো ইমামের পরিবারের তাঁবু থেকে। ইমাম উচ্চ কণ্ঠে তার বোন সাইয়েদা যায়নাব (আ.) কে ডাক দিলেন, “এর যত্ন নাও ।” শিশুটি শুনলো না এবং দৌড় দিলো ইমামের কাছে পৌঁছা পর্যন্ত এবং তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। শেইখ মুফীদ তাকে চিহ্নিত করেছেন আব্দুল্লাহ বিন (ইমাম) হাসান নামে, শিশুটি বললো, “আল্লাহর শপথ, আমি আমার চাচার কাছ থেকে সরে যাবো না।”
[তাবারির গ্রন্থে আছে] বাহর বিন কা‘আব ইমাম হুসাইন (আ.) কে আঘাত করলো তার তরবারি দিয়ে এবং শিশুটি বললো, “দুর্ভোগ হোক তোমার হে খারাপ চরিত্রের লোকের সন্তান। তুমি কি আমার চাচাকে হত্যা করতে চাও?” অভিশপ্ত শয়তান তাকে তার তরবারি দিয়ে আঘাত করলো, তা শিশুটি তার দুহাতের উপর নিলো এবং তা গোশত পর্যন্ত কাটলো এবং ঝুলতে লাগলো। শিশুটি কেঁদে উঠলো, “ও মা, আমার সাহায্যে আসো।” ইমাম তাকে কোলে তুলে নিলেন এবং বললেন, “হে ভাতিজা, সহ্য করো এ পরীক্ষা এবং তা তোমার জন্য বরকত মনে করো। তুমি শীঘ্রই মিলিত হবে তোমার ধার্মিক পিতৃপুরুষদের সাথে যারা হলেন আল্লাহর রাসূল (সা.) , ইমাম আলী বিন আবি তালিব (আ.), হামযা (আ.), জাফর (আত তাইয়ার) (আ.) এবং (ইমাম) হাসান বিন আলী (আ.)।” এরপর তিনি তাঁর হাত তুললেন দোআ করার জন্য এবং বললেন, “হে আল্লাহ, আকাশের বৃষ্টি ও পৃথিবীর প্রাচুর্য তাদের জন্য স্থগিত করে দাও। ইয়া রব, যদি তুমি তাদের আরও কিছু দিনের জন্য জীবন দাও, তাহলে তাদেরকে বিতাড়িত করো এবং শাসকদেরকে তাদের উপর সব সময় অসন্তুষ্ট রাখো, কারণ তারা আমাদের আমন্ত্রণ করেছে সাহায্য করার জন্য কিন্তু এরপর আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং আমাদেরকে হত্যা করেছে।”
তাবারি বলেন যে, ইমাম হুসাইন (আ.) তখন পদাতিক সৈন্যদের আক্রমণ করেন এবং তাদেরকে তার কাছ থেকে ঠেলে সরিয়ে দেন।শেইখ মুফীদ বলেন যে, পদাতিক সৈন্যরা ইমাম হুসাইন (আ.) এর সাথীদেরকে বাম ও ডান দিক থেকে আক্রমণ করে এবং তাদেরকে হত্যা করে যতক্ষণ না তিন থেকে চারজন ইমামের সাথে রয়ে যান।
তাবারি এবং (ইবনে আসীর) জাযারি একই ভাবে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে, যখন ইমাম হুসাইন (আ.) এর সাথে মাত্র তিন থেকে চারজন সাথী ছিলো তিনি একটি লম্বা জামা চাইলেন যা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। তা ছিলো ইয়েমেনের এবং খুব সূক্ষ্মভাবে সেলাই করা, তিনি এর দুই পাশের কিছু অংশ ছিঁড়ে দিলেন যেন তা তার শরীর থেকে খুলে নেয়া না হয়। তার একজন সাথী বললেন, “আমার মনে হয় আপনার পোশাকের নিচে বর্ম পড়লে ভালো করতেন।” ইমাম বললেন, “তা হলো অপমানকর জামা এবং তা পড়া আমার জন্য মানায় না।” বলা হয় যখন তিনি নিহত হন, বাহর বনি কা‘আব তার জামাটি তার শরীর থেকে লুট করে নিয়ে যায়, তা আবরণহীন অবস্থায় রেখে।
আযদি বলেন যে, আমর বিন শুয়াইব বর্ণনা করেছে মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান থেকে যে, বাহর বিন কা‘বের দুহাত দিয়ে শীতকালে পুঁজ বের হতো এবং গ্রীষ্মকালে তা কাঠের লাঠির মত শুকিয়ে যেতো।
শেইখ মুফীদ বলেন যে, যখন মাত্র তিন জন সাথী ইমাম হুসাইন (আ.) এর সাথে ছিলো তিনি শত্রুদের দিকে ফিরলেন এবং ঐ তিন জন তাঁকে রক্ষা করতে দাঁড়ালেন এবং সেনাবাহিনীকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন যতক্ষণ না তারা শহীদ হয়ে গেলেন এবং ইমাম একা হয়ে গেলেন। তিনি মাথায় এবং শরীরে আহত ছিলেন, এরপর তিনি তাদের আক্রমণ করলেন বাম দিক ও ডান দিক থেকে এবং তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিলেন।
হামীদ বিন মুসলিম বলে যে, “আল্লাহর শপথ, আমি একজন বিধ্বস্ত মানুষকে এত বীরত্ব প্রদর্শন করতে দেখিনি যার পুত্র সন্তানদের এবং বন্ধুদের হত্যা করা হয়েছে, তবুও তার হৃদয় ছিলো অপরাজেয়। পদাতিক সৈন্যরা তাকে আক্রমণ করেছে এবং তিনি তাদেরকে মোকাবিলা করেছেন এক নেকড়ের মত যে ভেড়ার পালকে আক্রমণ করে এবং তাদেরকে ডান-বামে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।” যখন শিমার তা দেখলো, সে অশ্বারোহীদের ডাকলো এবং পদাতিক সৈন্যদের সারির পেছনে তাদের অবস্থান নিতে বললো। এরপর সে তীরন্দাজদের আদেশ করলো ইমামের প্রতি তীর ছুঁড়তে। এমন সংখ্যায় তীর তার দেহে বিদ্ধ হলো যে তা দেখতে সজারুর কাটার মত লাগলো, তখন তিনি তাদের উপর থেকে তার হাত সরিয়ে নিলেন এবং তারা এগিয়ে এলো এবং তার দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকলো।
যায়নাব (আ.) তাঁবুর দরজায় এলেন এবং উমর বিন সা’আদকে উচ্চ কণ্ঠে ডাকলেন, “দুর্ভোগ তোমাদের জন্য হে উমর (বিন সা’আদ) আবু আব্দুল্লাহকে হত্যা করা হচ্ছে আর তুমি তাকিয়ে দেখছো?” সে কোন উত্তর দিলো না এবং তিনি আবার বললেন, “দুর্ভোগ তোমার উপর, তোমাদের মধ্যে কি একজন মুসলমানও নেই?” কিন্তু আবারও কেউ উত্তর দিলো না।
তাবারি বলেন যে, উমর বিন সা’আদ ইমাম হুসাইন (আ.) এর কাছে গেলো এবং যায়নাব (আ.) বললেন, “হে উমর বিন সা’আদ, আবু আব্দুল্লাহকে হত্যা করা হচ্ছে আর তুমি তাকিয়ে দেখছো?”বর্ণনাকারী বলে যে, আমি যেন এখনও দেখতে পাচ্ছি তার গাল ও দাড়িতে অশ্রু ঝরছে এবং সে যায়নাব (আ.) এর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
সাইয়েদ ইবনে তাউস বলেন যে, ইমাম হুসাইন (আ.) অনেক আঘাতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন এবং তাকে সজারুর মত (তীরের কারণে) দেখতে লাগছিলো। সালেহ বিন ওয়াহাব ইয়াযনী একটি বর্শা তার একপাশে বিদ্ধ করে এবং তিনি ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে যান বাম গালের ওপরে। এরপর তিনি বললেন, “আল্লাহর নামে, এবং আল্লাহর অনুমতিতে এবং আল্লাহর রাসূলের বিশ্বাসের ওপরে।” এরপর উঠে দাঁড়ালেন।
বর্ণনাকারী বলে যে, সাইয়েদা যায়নাব (আ.) তাঁবুর দরজা থেকে বেরিয়ে এলেন এবং উচ্চ কণ্ঠে বললেন, “হে আমার ভাই, হে আমার অভিভাবক, হে আমার পরিবার, হায় যদি আকাশ পৃথিবীতে ভেঙ্গে পড়তো এবং পাহাড়গুলো চূর্ণ হয়ে মরুভূমিতে ছড়িয়ে যেতো!”
বর্ণিত হয়েছে, শিমার তার সাথীদের উচ্চ কণ্ঠে ডেকে বললো, “এ মানুষটির জন্য তোমরা অপেক্ষা করছো কেন?” তখন তারা তাকে সব দিক থেকে আক্রমণ করলো।
হামীদ বিন মুসলিম বলে যে, ইমাম হুসাইন (আ.) একটি পশমী লম্বা জামা পড়েছিলেন এবং মাথায় পাগড়ী এবং চুলে ওয়াসমাহর কলপ ছিলো। আমি তাকে শহীদ হওয়ার আগে বলতে শুনলাম, যখন তিনি পায়ের উপর ছিলেন, কিন্তু যুদ্ধ করছিলেন যেন ঘোড়ায় চড়ে আছেন এবং নিজেকে তীর থেকে রক্ষা করছিলেন এবং অশ্বারোহী বাহিনী সব দিকে ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিলো এবং তিনি তাদের তরবারি দিয়ে আক্রমণ করলেন, “তোমরা একত্রে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছো? আল্লাহর শপথ, আমার পরে তোমরা আর কাউকে হত্যা করবে না যার হত্যাতে আল্লাহ তোমাদের উপর এর চাইতে বেশী ক্রোধান্বিত হবেন। আল্লাহর শপথ, আমি চাই যে আল্লাহ আমাকে ভালোবাসুন তোমাদের ঘৃণার পরিবর্তে এবং তিনি আমার প্রতিশোধ নিন তোমাদের উপর এমন এক মাধ্যমে যে সম্পর্কে তোমরা সচেতন নও। সাবধান, যদি তোমরা আমাকে হত্যা করো, আল্লাহও তোমাদেরকে হত্যা করবেন এবং তোমাদের রক্ত ঝরাবেন। এরপর তিনি তোমাদের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিবেন না যতক্ষণ না তিনি ভয়ানক শাস্তিকে দ্বিগুণ করবেন।”
বর্ণিত আছে যে, তিনি সেদিন দীর্ঘ সময়ের জন্য বেঁচে ছিলেন এবং সেনাবাহিনী যদি চাইতো তাকে হত্যা করতে পারতো। কিন্তু তারা এ বিষয়ের জন্য একে অন্যকে উপযুক্ত মনে করলো এবং প্রত্যেক দল চাইলো অন্যরা তাকে হত্যা করুক। শিমার তাদের মাঝে চিৎকার করে বললো, “কিসের জন্য তোমরা অপেক্ষা করছো? এ লোককে হত্যা করো। তোমাদের মা তোমাদের জন্য কাঁদুক।” এরপর তারা তাকে সবদিক থেকে আক্রমণ করলো।
শেইখ মুফীদ বলেন যে, যারাহ বিন শারীক তার বাম হাতকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং তার কাঁধে তরবারির আরেকটি আঘাত বসিয়ে দেয় এবং তিনি তার মুখের উপর পড়ে গেলেন।তাবারি বলেন যে, তখন তারা পিছনে হটে গেলো এবং তিনি ছিলেন খুবই খারাপ অবস্থায় এবং তিনি উঠে দাঁড়ালেন ও পড়ে গেলেন। সেই মুহূর্তে সিনান বিন আনাস বিন আমর নাখাই তাকে বর্শা দিয়ে আঘাত করলো এবং মাটিতে ফেলে দিলো। শেইখ মুফীদ ও তাবারসি বলেন যে, খাওলি বিন আল আসবাহি দ্রুত এগিয়ে এলো এবং ঘোড়া থেকে নেমে এলো তার মাথা বিচ্ছিন্ন করতে, কিন্তু সে কাঁপতে লাগলো। শিমার বললো, “আল্লাহ তোমার হাত ভেঙ্গে দিক, কেন তুমি কাঁপছো?” এরপর সে ঘোড়া থেকে নেমে এলো এবং তার মাথা কেটে ফেললো।
আবুল আব্বাস আহমেদ বিন ইউসুফ দামিশকি ক্বিরমানি তার ‘আখবারুল দাওল’ গ্রন্থে বলেছেন যে, ইমাম হুসাইন (আ.) এর পিপাসা তীব্র হয়ে উঠলো, কিন্তু তারা তাকে পানি পান করার জন্য পানি দেয় নি। এক পেয়ালা পানি তার হাতে এলো এবং তিনি উপুড় হলেন তা পান করার জন্য। হাসীন বিন নামীর তার দিকে একটি তীর ছুঁড়লো, যা তার থুতনি ভেদ করলো এবং পেয়ালাটি রক্তে ভরে গেলো। তখন তিনি তার দুহাত আকাশের দিকে তুলে বললেন, “হে আল্লাহ, তাদের সংখ্যা কমিয়ে দাও, তাদের প্রত্যেককে হত্যা করো এবং তাদের মধ্য থেকে একজনকেও পৃথিবীর উপর ছেড়ে দিও না।” তখন তারা তাকে সব দিক থেকে আক্রমণ করলো এবং তিনি তাদেরকে বাম ও ডান দিকে তাড়িয়ে দিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না যারাহ বিন শারীক তার বাম কাঁধে আঘাত করে এবং আরেকটি আঘাত কাঁধে ঢুকিয়ে দেয় এবং তাকে মাটিতে ফেলে দেয়। শিমার তখন তার ঘোড়া থেকে নেমে এসে তার মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং তা খাওলি আসবাহির হাতে হস্তান্তর করে। এরপর তারা তার জামা- কাপড় লুট করে।
সাইয়েদ ইবনে তাউস, ইবনে নিমা, শেইখ সাদুক্ব, তাবারি, ইবনে আসীর জাযারি, ইবনে আব্দুল বির, মাসউদী এবং আবুল ফারাজ বলেছেন যে, অভিশপ্ত সিনান (বিন আনাস) তার মাথা বিচ্ছিন্ন করেছিলো। সাইয়েদ ইবনে তাউস বলেন যে, সিনান এগিয়ে এলো এবং বললো, “যদিও আমি জানি যে সে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নাতি এবং তার মা-বাবা মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তবুও আমি তার মাথা কাটবো।” এরপর সে তার পবিত্র ঘাড়ে আঘাত করে তার তরবারি দিয়ে এবং তার পবিত্র ও সম্মানিত মাথা আলাদা করে ফেলে।
ইমাম জাফর আস সাদিক্ব (আ.) বলেছেন, যখন ইমাম হুসাইন (আ.) এর বিষয়টি এই পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন ফেরেশতারা আল্লাহর সামনে কাঁদতে থাকে এবং বলে, “হে আল্লাহ এ হুসাইন আপনার মেহমান, সে আপনার রাসূলের নাতি”, তখন আল্লাহ ইমাম আল ক্বায়েম (আল মাহদী)-এর একটি ছবি দেখালেন এবং বললেন, “আমি তাদের উপর প্রতিশোধ নিবো এর মাধ্যমে।”
বর্ণিত হয়েছে যে, মুখতার সিনানকে গ্রেফতার করে এবং তার প্রতিটি আঙ্গুল একের পর এক কেটে ফেলে। এরপর সে হাত দুটো ও পা দুটো কেটে ফেলে এবং তাকে একটি বড় পাত্রে ছুঁড়ে ফেলে, যাতে ছিলো ফুটন্ত জলপাই তেল।
বর্ণনাকারী বলেন, যে মুহূর্তে তারা ইমাম হুসাইন (আ.) এর মাথা কেটে ফেললো ঠিক তখনই এক প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়। আর তা পুরো দিগন্তকে অন্ধকারে ছেয়ে ফেললো। এরপর এক লাল ঝড় বইলো যার কারণে কিছু দেখা যাচ্ছিলো না এবং সেনাবাহিনী ভাবলো আল্লাহর অভিশাপ বোধ হয় নামলো। এরকম এক ঘণ্টা চললো এবং তার পর থামলো।
হিলাল বিন নাফে’ বলেন যে, আমি উমর বিন সা’আদের সাথীদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং কেউ একজন চিৎকার করে বললো, “অধিনায়ক, সুসংবাদ নিন, শিমার হুসাইনকে হত্যা করেছে।” তখন আমি তার শাহাদাতের স্থানে গেলাম এবং তার পাশে দাঁড়ালাম এবং তিনি মারা যাচ্ছিলেন। আল্লাহর শপথ, আমি এর চেয়ে ভালো কোন লাশ যা রক্তে ভেজা ছিলো এবং তার চেহারার চাইতে আলোকিত কোন চেহারা দেখিনি। তার চেহারার আলো।
বাংলা৭১নিউজ/সংগৃহিত: পার্সটুডে