আজ ২০ জুন কামাল লোহানীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। । বাংলাদেশের বিপ্লবী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। কিছু সময়ের জন্য কিংবা জীবনে হঠাৎ করে বিপ্লবী হয়ে ওঠা মানুষের সন্ধান হয়তো অনেক মিলতে পারে; কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিপ্লবের প্রতি আস্থা রাখা, লড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বিরল।
কামাল লোহানী সেইসব বিরল মানুষের একজন। তিনি মানুষের অধিকার, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পূর্ব পুরুষদের সংগ্রামের উত্তরাধিকারকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে আমৃত্যু লড়ে গেছেন। তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে চোখে ভালো দেখতে পেতেন না লোহানী ভাই; তবু মানুষের জন্য কিছু করার আকাঙ্ক্ষা থেকে মনের দৃষ্টি মেলে লিখতেন তিনি। বিশ্বাস করতেন জনগণে, মনে করতেন গণশক্তির প্রবল জোয়ারের কাছে কোনো শক্তিই টিকতে পারে না। নিজের লেখার মধ্যেই প্রকাশ ঘটাতেন এসব। তিনিই সদর্পে উচ্চারণ করেছেন ‘এই দেশ, এই জনগণ, আমার অস্তিত্বের স্বকল্প পরিচয়।’ তিনি মনে করতেন, গণশক্তির সেই প্রবল জোয়ার সৃষ্টি করতে হলে তাঁর চেতনাকে শাণিত করে তুলতে হয়। আর সেটা পারে সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন।
কামাল লোহানীর অনেক পরিচয়। রাজনীতি, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা- মানুষের এমন অনেক জীবনঘনিষ্ঠ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম ক্ষেত্র ছিল সংস্কৃতি। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনীতির পাঠ শুরু। তারপর ক্রমান্বয়ে সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থেকে কাজ করেছেন দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তা, দৈনিক জনপদ, দৈনিক বাংলার বাণী, দৈনিক আজাদসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সম্পৃক্ত হয়ে বিভিন্ন মেয়াদে সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক, সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
পিআইবি ও বেতারের ট্রান্সক্রিপশন পরিচালক ছিলেন কামাল লোহানী। সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে তিনি দুই মেয়াদে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া ছায়ানটের প্রথম সাধারণ সম্পাদক যখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন, তিনি তার হাল ধরেন। ১৯৬৭ সালে কামাল লোহানী ও হাসান পারভেজ মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পটভূমি রচনায় অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখে সংগঠনটি।
১৯৭১ সালে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৫মে মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এর অন্যতম সংগঠক ও বার্তা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কামাল লোহানী। বেতারে তাঁর ভরাট কণ্ঠেই মুক্তিযুদ্ধে প্রথম বিজয়ের খবর জানতে পারে দেশবাসী।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিষ্ঠিত হয় গণশিল্পী সংস্থা। তিনি এর প্রতিষ্ঠা ও বিস্তৃতি ঘটাতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। দীর্ঘদিন সেই সংগঠনে সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের অগ্রসেনানী সোমেন চন্দকে যখন মানুষ ভুলতে বসেছে, সেই সময়ে সোমেন চন্দ চর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আমৃত্যু তিনি এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন।
সোমেন চন্দের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘সোমেন চন্দ চর্চা কেন্দ্র’ গতিশীল ধারায় অবস্থান করেছে। প্রতিবছর পুরান ঢাকার ঋষিকেশ দাশ রোডে সোমেন চন্দের স্মৃতিতে নির্মিত অস্থায়ী বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, আলোচনাসভা ইত্যাদির আয়োজন ছিল। এর মধ্য দিয়ে সোমেন চন্দের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল তাঁর। গত ২৪ মে ২০২০ সোমেন চন্দের শততম জন্মবার্ষিকী সাড়ম্বরে উদযাপন করার পরিকল্পনা ছিল আমাদের। কিন্তু করোনা মহামারি ও লোহানী ভাইয়ের হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া-এই দুই কারণে সে পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ পায়নি।
সোমেন চন্দকে যেখানে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, সেখানে স্থায়ীভাবে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা ছিল লোহানী ভাইয়ের। মৃত্যুর আগে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করাসহ নানাভাবে চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি।
অসুস্থ শরীরেও অসম্ভব মনোবলের অধিকারী ছিলেন তিনি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও অসংখ্য কাজের পরামর্শ ও পরিকল্পনা বাতলে দিতেন। মাঝে মাঝে ফোন করে বিভিন্ন কাজের কথা বলতেন, প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেন। দুর্দান্ত সাহসী ও দৃঢ়চেতা এ মানুষটি ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত উদীচীর সভাপতি ছিলেন। যুক্ত ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত উদীচী কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে। সংগ্রামের নানা পথ রচনায় তিনি আমাদের পথ দেখিয়েছেন, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
তাঁর নেতৃত্বে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা গণজাগরণে সামনে থেকে লড়াই করেছে উদীচী; ২০১৬ সালে আয়োজন করেছে ‘দক্ষিণ এশীয় সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সাংস্কৃতিক কনভেনশন’। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, চীন ও জাপানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন ওই কনভেনশনে। সেখানে তাঁকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় দক্ষিণ এশীয় সাংস্কৃতিক মঞ্চ।
বাংলা ভাষার অবমাননা তাঁকে সব সময় ব্যথিত করেছে এবং তিনি তা নিয়ে সর্বদা উদ্বিগ্ন থেকেছেন। বাংলা ভাষার অবহেলা ও বিকৃতিরোধ এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর দাবিতে ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। ২০১৭ সালে তাই উদীচীর মাধ্যমে ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী ভাষা অভিযাত্রা করার আহ্বান জানান তিনি। এ সময় নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নামফলক বাংলায় লেখার দাবি উঠে আসে।
লোহানী ভাই গণমানুষের মুক্তির লক্ষে কর্মরত অসংখ্য মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের ভরসাস্থল ছিলেন। আমরা দেখেছি, নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মোহাম্মদ ত্বকী সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হলে সেখানে স্থবিরতা নেমে আসে। সেই স্থবিরতা কাটাতে যে কজন মানুষ নারায়ণগঞ্জবাসীর পাশে থেকেছেন, কামাল লোহানী তাঁদের অন্যতম। সেখানে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে লোহানী ভাই তার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন ওতপ্রোতভাবে।
২০১৭ সালে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রগতিশীল লেখকদের লেখাগুলো বাদ দেওয়ার পরও তিনি প্রৌঢ়ত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নেমে এসেছেন রাস্তায়। তাঁরই নেতৃত্বে উদীচী শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ওই ঘৃণ্য ও চক্রান্তমূলক কাজের প্রতিবাদ হয়েছে। ঢাকার বাইরেও বহু প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে ছুটে গেছেন তিনি। তাদের সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
তিনি সত্য বলতে কখনো দ্বিধা করতেন না এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ—তার জন্য সবসময় সোচ্চার থেকেছেন। তাঁর এই সময়ে চলে যাওয়াটা আমাদের আরেক মহামারির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমরা হারিয়ে ফেলেছি শির উঁচু করে কথা বলা রাজপথ কাঁপানো অকুতোভয় এক সংস্কৃতি সংগ্রামীকে। বিশ্বাস করি, তাঁর রেখে যাওয়া কাজ অনন্তকাল আমাদের শক্তি ও সাহস জোগাবে। তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন চিরভাস্বর হয়ে।
লেখক: সদস্য উদীচী
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ