দেশের ৫২তম মহান স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস পালিত হয়েছে ২৬ মার্চ। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ ও চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। এরপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিরা দিবসটি উদ্যাপন করেন। বিশ্বব্যাপী চলা করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর সীমিত পরিসরে এবং কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপিত হয়। সে তুলনায় এবার লোক সমাগম বেশি হয়েছে। সরকারের অন্যন্য সংস্থার মত বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডও (পাউবো) দিবসটি পালন করেছে।
স্বাধীনতা দিবসে পাউবো’র ভূমিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক প্রকৌশলী ফজলুর রশিদ বলেছেন, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের রয়েছে এক গৌরবজ্জল ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই প্রতিষ্ঠাণটির কর্মকর্তা-কর্মচারিরা পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। নদী মাতৃক বাংলাদেশে নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ, বাঁধ নির্মাণ, নদী খনন, বন্যার কবল থেকে মানুষকে রক্ষা, সেচের মাধ্যমে অধিক ফসল উৎপাদনে সেচ প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড যে কতটা গুরুত্বপূর্ন তা ভালভাবেই জানতেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বন্যামুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলা। সরকার সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই রূপকল্প-২০৪১ সাজিয়েছে।এটা এখন বাস্তবতা যে, সরকারের বহুমুখি পদক্ষেপের কারণে পাউবো একটি গতিশীল প্রতিষ্ঠাণে পরিণত হয়েছে।
প্রকৌশলী ফজলুর রশিদ বলেন, দেশের নদ-নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করছে পাউবো। আর আওয়ামী লীগ সরকারের বহুমুখি পদক্ষেপের কারণেই পানি উন্নয়ন বোর্ড আজ এতটা সফলতার মুখ দেখতে পেরেছে। নদী নির্ভর মানুষ পাচ্ছেন এর সুফল। আওয়ামী লীগ সরকারই ১৯৯৯ সালে জাতীয় পানি নীতি এবং ২০০১ সালে জাতীয় পানি সম্পদ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এছাড়াও ঐতিহাসিক ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯৯৭ সাল থেকে শুষ্ক মৌসুমে ন্যুনতম পানি প্রবাহ নিশ্চিত করেছে। হাওর এলাকায় ২ কোটি মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০০ সালে বাংলাদেশ হাওর ও জলাশয় উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করে। তিনি বলেন, উত্তরে বিস্তৃৃর্ণ হিমালয় পর্বতমালা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনা এ ৩টি নদী বাহিত পলল ভূমিতে গড়া আমাদের বাংলাদেশ। এখানে অসংখ্য নদ-নদী সমগ্র দেশে জালের মত ছড়িয়ে রয়েছে। নদ-নদী সমূহের মধ্যে বড় তিনটি আন্তর্জাতিক নদী ( পদ্মা, মেঘনা, যমুনা)-সহ মোট ৫৭ টি সীমান্তনদী এবং বাকী গুলি দেশের আভ্যন্তরীন অববাহিকা ভিত্তিক অথবা প্রধান নদীর শাখা বা উপশাখা হিসেবে বহমান। সাতান্নটি সীমান্ত নদীর মধ্যে চুয়ান্নটি বাংলাদেশ-ভারত এবং তিনটি বাংলাদেশ-মিয়ানমার এর সীমানা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
দেশের বন্যা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাউবো মহাপরিচালক বলেন, পাউবো’র ৬৪ টি জেলার অভ্যন্তরস্থ ছোট নদী, খাল এবং জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্প চলমান থাকার কারণে ২০২০ এবং ২০২১ সালে দেশে তেমন একটা বন্যা হয়নি। তবে ২০১৯ সালের বন্যার শুরুটা জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ছিল। ওইসময় ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ী অববাহিকার বাংলাদেশ ও ভারতের উজানের বিস্তৃৃত অংশে টানা মৌসুমি বর্ষণের কারণে দেখা দেয়। বিশেষ করে অতি ভারি বর্ষণের প্রভাবে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এলাকা বন্যা কবলিত হয়। এ বন্যার তীব্রতার মাত্রা স্থানবিশেষে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশী হওয়ায় কয়েকটি স্থানে ইতোপূর্বের পানি সমতল রেকর্ড অতিক্রম করে।
যেকোন বন্যা মোকাবেলায় পাউবোর আগাম প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকৌশলী ফজলুর রশিদ বলেন, বন্যা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী বন্যা মৌসুমের পূর্বেই পাউবোকে সাথে নিয়ে বাঁধ ও নদীতীরে সম্ভাব্য ভাঙ্গনের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসমূহ চিহ্নিত করেন এবং ভাঙ্গনরোধে আগাম কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। বিশেষ করে বন্যা মোকাবেলায় পাউবোর ৯টি প্রশাসনিক জোনের প্রত্যেকটির জন্য ২ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি বাঁধ ও নদী তীরের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে। পানি সমতলে বৃদ্ধি পাওয়ার পূর্বেই বন্যা মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে জরুরী ভিত্তিতে ঝুঁকিপূর্ন এলাকাসমূহের মেরামত কাজ বাস্তবায়ন করা হয়। এছাড়াও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সারাদেশে আকষ্মিক বন্যা ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন ইত্যাদি মোকাবেলার জন্য মার্চ-এপ্রিল মাসে ৯টি জোনের কমপক্ষে ২৬টি বিভাগীয় দপ্তরকে আসন্ন বন্যা এবং নদীভাঙ্গন প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে জিওটিউব, জিওব্যাগ, বালি, বস্তা সেলাই সরঞ্জাম সাইটে মজুদরেখে আসন্ন দুর্যোগ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ প্রদান করে। বন্যা এবংনদীভাঙ্গনে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আগাম ব্যবস্থা হিসেবে জিওব্যাগসহ অন্যান্য সামগ্রী মজুদ করা হয় যা বন্যাকালীন সময়ে ব্যবহৃত হয়। দেশে বন্যা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের স্বার্থে বাপাউবো’র মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সকল প্রকার ছুটি স্থগিত করা হয়। পাউবো’র সদর দপ্তর ওয়াপদা ভবনে বন্যা পূর্বাভাস এবং সতর্কীকরন কেন্দ্র হতে সারাদেশে নদ-নদীর পানির লেভেল, বৃষ্টিপাতের তথ্য এবং বন্যা পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছে। অনুরূপভাবে সদর দপ্তরে নদীভাঙ্গন, নির্মিতবাঁধ, নদীতীর সংরক্ষণ কাজ ও অন্যান্য অবকাঠামো সমূহের ক্ষয়ক্ষতির তথ্যসংগ্রহ ও তথ্য প্রদানের লক্ষ্যে ২৯ এপ্রিল হতে “কেন্দ্রীয় বন্যা তথ্য কেন্দ্র্র” চালু করা হয়।
বন্যার ক্ষয়ক্ষতি লাঘবে ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাউবো মহাপরিচালক বলেন, বিগত বছরগুলোর মতোই পানি উন্নয়ন বোর্ড অনুন্নয়ন রাজস্ব বাজেটের আওতায় বাঁধ ও অন্যান্য পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় মেরামত কাজ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এটি একটি অপ্রতুল ব্যবস্থা। এখানে অর্থের কারণে অনেক সময় কাজের গতি স্লথ হয়ে যায়। বর্তমানে বন্যা জনিত ক্ষয়ক্ষতি সহনীয় মাত্রায় ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে বিবেচনায় নিয়ে সম্পদের সমন্বিত টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এটি করা হয়েছে রূপকল্প ২০৪১ ও ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে। একারণে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী বেসিন, তিস্তা নদী বেসিন, গঙ্গা-পদ্মা নদী বেসিন, আপার মেঘনা বেসিন (সুরমা-কুশিয়ারা নদী বেসিন সহ), লোয়ার মেঘনা বেসিন, কর্ণফুলী নদী বেসিন (হালদা নদী বেসিন সহ), সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদী বেসিনভিত্তিক সমীক্ষা চালানো হবে। এই সমীক্ষা রিপোর্টের সুপারিশের আলোকে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি লাঘবে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বন্যার ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
প্রকৌশলী ফজলুর রশিদ বলেন, দেশকে বন্যামুক্ত, সুষ্ঠ পানি ব্যবস্থাপনা এবং আরও অধিক ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে পাউবো’র রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এজন্য আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে এবং ২০০ বছরের রিটার্ন পিরিয়ড বিশ্লেষন করে প্রধান প্রধান নদ-নদীসমূহের দুই তীরকে স্থায়ীকরণের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে আনার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলকায় দেওয়া বাঁধসমূহ প্রশস্থ ও উঁচু করা গেলে বন্যার ঝুঁকি সহনীয় মাত্রায় রাখা যাবে। উপকূলীয় বাঁধসমূহ পুনরাকৃতিকরণ ও শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে ওইসব এলাকার বন্যার প্রকোপ কমানো সম্ভব হবে। আর ছোট নদ-নদী, খাল ও জলাশয়সমূহকে খননের মাধ্যমে পানি ধারন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বন্যার প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।
একই সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের নদ-নদীগুলোকে মেগা ড্রেজিং এর মাধ্যমে এর নাব্যতা ধরে রাখার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। যাতে করে বর্ষা মৌসুমের পানিকে ধরে রেখে শুষ্ক মৌসুমে কৃষি কাজে লাগানো সম্ভব হয়। এতে করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা সহ সরকারের রূপকল্প-২০৪১ ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচবি