বাংলা৭১নিউজরিপোর্ট : নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। বাঁচবে এদেশের কৃষক, জেলে, মেহনতি মানুষ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বন্যামুক্ত ‘সোনার বাংলা’। এজন্যই তিনি নদী মাতৃক বাংলাদেশে নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ, নদী শাসন, বন্যানিয়ন্ত্রন বাঁধ নির্মাণ, নদী খনন, বন্যার কবল থেকে মানুষকে রক্ষা, সেচের মাধ্যমে অধিক ফসল উৎপাদনে সেচ প্রকল্প গ্রহণ এবং দেশের খাল-বিল-জলাভূমি সংরক্ষণের জন্য কার্যকর নির্দেশনা দিয়েছিলেন। জাতির পিতার এই মহান নির্দেশনা বাস্তবায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যে কতটা গুরুত্বপূর্ন তা ভালভাবেই জানতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর জানতেন বলেই পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু দেশের পানি সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে অনেকগুলো ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এসব পদক্ষেপের অন্যতম হচ্ছে- ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা এবং দেশের পানি সম্পদ ব্যবস্থা, সেচ ব্যবস্থা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা।
যে পাউবো নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল; সেই মহান নেতার জন্ম শতবার্ষিকীকে সামনে রেখে ভিশন ২০২১ এর পক্ষ থেকে এই প্রতিষ্ঠাণের মহাপরিচালক প্রকৌশলী এ এম আমিনুল হক এর মুখোমুখি হয়েছি একগুচ্ছ প্রশ্ন নিয়ে। বাংলা৭১নিউজ.কম-কে দেওয়া সাক্ষাতকারটি তুলে ধরা হলো:
বাংলা৭১নিউজ: পাউবো নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নটাকে আপনি এই সংস্থার প্রধান হিসাবে কিভাবে দেখেন?
পাউবো মহাপরিচালক: দেখুন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে বঙ্গবন্ধুর এই যে নিবিড় সম্পর্ক; এটি পাউবো’র সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীই কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের রয়েছে এক গৌরবজ্জল ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। আমার সৌভাগ্য সেই মহান নেতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন বার্ষিকীতে আমি এমন একটি সংস্থা প্রধানের দায়িত্ব পালন করছি; যে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে জাতির পিতার অনেক বড় স্বপ্ন ছিল।
আপনারা জানেন, অগ্নিঝরা মার্চ বাঙ্গালী জাতির জীবনে অনেক গৌরবান্বিত। আর এই মার্চের ১৭ তারিখ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী পালন করবে সমগ্র জাতি। এটি বাঙ্গালী জাতির জন্য অনেক অহংকার ও গর্বের দিন। যে মহান নেতার জন্ম না হলে আমরা স্বাধীনতা পেতাম না, পেতাম না একটি স্বাধীন মানচিত্র। সেই মহান নেতা ১৯২০ সালের এইদিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মেছিলেন। ছাত্র বয়সেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সকল আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। যার কারণে তিনি বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৭১ এর মার্চে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১ এর ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু এক বিশাল জনসমাবেশে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। পরবর্তীতে ১৯৭১ এর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দেন এবং ঐ রাতেই তিনি পাকিস্তান শাসক কর্তৃক গ্রেফতার হন। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেন। এরপর তিনি নদী মাতৃক বাংলাদেশে নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ, নদী শাসন, বন্যানিয়ন্ত্রন বাঁধ নির্মাণ, নদী খনন, বন্যার কবল থেকে মানুষকে রক্ষা ও সেচ প্রকল্প গ্রহণের জন্য পাউবো’কে নির্দেশনা দেন। এই মহান নেতার জন্ম শতবার্ষিকী পালনের ক্ষেত্রে আমরা ইত্যেমধ্যেই বেশ কিছু কর্মসূচি নিয়েছি। সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য কাজ চলছে।
বাংলা৭১নিউজ: বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতে পাউবোর উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১০ বছরের ভূমিকাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
পাউবো মহাপরিচালক: দেখুন, গত দশ বছরে পাউবোর অনেক সাফল্য। আমরা যদি বিষয়টাকে এভাবে বলি যে, বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে দেশের বন্যা উপদ্রুত বিস্তীর্ন এলাকাকে যথাসম্ভব বন্যামুক্ত করে একটি ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলার। আমরা এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই কাজ করছি। ১৯৫৯ সনে এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ইপিওয়াপদা)। ১৯৭২ সনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির আদেশ নং: ৫৯ মোতাবেক ইপিওয়াপদা থেকে আলাদাভাবে সম্পূর্ণ স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) গঠন করেন।একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু উন্নয়নের যে রোড ম্যাপ প্রনয়ণ করেছিলেন, সেখানে পাউবোকে অনেক গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্ত ‘৭৫ এর ১৫ আগষ্টের কালো রাতের সেই ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা স্তব্ধ করে দেয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে দেখা সোনার বাংলা গড়ে তোলার রোডম্যাপ। এই কালো মেঘের অশুভ ছায়া বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল।
এই ধকল কাটাতে নানামুখি সংস্কার ও পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যার ধারাবাহিকতায় জাতীয় পানি নীতি-১৯৯৯ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে পাউবো আইন, ২০০০ প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের আওতায় পানি সম্পদ মন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট পানি পরিষদের মাধ্যমে বোর্ডের শীর্ষ নীতি নির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের বহুমুখি পদক্ষেপের কারণে পাউবো এখন গতিশীল একটি প্রতিষ্ঠাণে পরিণত হয়েছে। একটি কথা না বললেই নয়: আর তা হচ্ছে- দেশের নদ-নদী নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়শ:ই বলেন, বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই দেশের নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। দেশের নদ-নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করছে পাউবো। আর আওয়ামী লীগ সরকারের বহুমুখি পদক্ষেপের কারণেই পানি উন্নয়ন বোর্ড আজ এতটা সফলতার মুখ দেখতে পেরেছে। নদী নির্ভর মানুষ পাচ্ছেন এর সুফল।
তিনি বলেন, একথা বললাম এ কারণে যে- আওয়ামী লীগ সরকারই ১৯৯৯ সালে জাতীয় পানি নীতি এবং ২০০১ সালে জাতীয় পানি সম্পদ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এছাড়াও ২১০০ সালকে টার্গেট করে ১০০ বছরের ডেল্টা প্ল্যান প্রনয়ণ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেই ভারতের সাথে ঐতিহাসিক ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার ফলে ১৯৯৭ সাল থেকে শুষ্ক মৌসুমে ন্যুনতম পানি প্রবাহ নিশ্চিত হয়। হাওর এলাকায় ২ কোটি মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০০ সালে বাংলাদেশ হাওর ও জলাশয় উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করে। তিনি বলেন, উত্তরে বিস্তৃৃর্ণ হিমালয় পর্বতমালা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনা এ ৩টি নদী বাহিত পলল ভূমিতে গড়া আমাদের বাংলাদেশ। এখানে অসংখ্য নদ-নদী সমগ্র দেশে জালের মত ছড়িয়ে রয়েছে। নদ-নদী সমূহের মধ্যে বড় তিনটি আন্তর্জাতিক নদী (পদ্মা, মেঘনা, যমুনা)-সহ মোট ৫৭ টি সীমান্তনদী এবং বাকী গুলি দেশের আভ্যন্তরীন অববাহিকা ভিত্তিক অথবা প্রধান নদীর শাখা বা উপশাখা হিসেবে বহমান। সাতান্নটি সীমান্ত নদীর মধ্যে চুয়ান্নটি বাংলাদেশ-ভারত এবং তিনটি বাংলাদেশ-মিয়ানমার এর সীমানা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক তিনটি বড় নদীর সম্মিলিত অববাহিকার মোট আয়তন ১ দশমিক ৭২ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। যার মাত্র সাত শতাংশ বাংলাদেশের সীমানায় অবস্থিত। এ বিরাট অববাহিকার বৃষ্টিপাতের পানি বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত নদীর মাধ্যমে সাগরে মিশে যায়। পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনার মিলিত প্রবাহ কখনো কখনো বর্ষাকালে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে। এ প্রবাহ সমৃদ্ধ নদীমালা দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিশ্ব মানচিত্রে একটি অনন্য রূপ দিয়েছে।
বাংলা৭১নিউজ: বিগত বন্যাটা কোন দিক থেকে এসেছে এবং এর প্রভাব কী ছিল?
পাউবো মহাপরিচালক: দেখুন, ২০১৯ সালের বন্যার শুরুটা জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ী অববাহিকার বাংলাদেশ ও ভারতের উজানের বিস্তৃৃত অংশে টানা মৌসুমি বর্ষণের কারণে দেখা দিয়েছিল। অতি ভারি বর্ষণের প্রভাবে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এলাকা বন্যা কবলিত হয়েছিল। একই মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যভাগ হতে বাংলাদেশ ও উজানের অংশে বৃষ্টিপাতের মাত্রা হ্রাস পেলে নদীসমূহের পানি সমতল কমতে থাকে। এতে করে ক্রমান্বয়ে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়। ওই বন্যার তীব্রতার মাত্রা স্থানবিশেষে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশী হওয়ায় কয়েকটি স্থানে ইতোপূর্বের পানি সমতল রেকর্ড অতিক্রম করেছিল।
অন্যদিকে, উত্তরাঞ্চলের উজানে সীমান্ত সংলগ্ন ভারতীয় এলাকাগুলোতে অতি ভারি বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়। ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ঘাঘট ইত্যাদি নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং উত্তরাঞ্চলীয় জেলাসমূহের প্লাবনভূমি সহ নিম্নাঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়।এর প্রভাবে নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, নওগাঁ, জামালপুর, টাঙ্গাইল ইত্যাদি জেলার প্লাবনভূমি সহ নিম্নাঞ্চল বন্যা কবলিত হয়।
আবার মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ী অববাহিকার বাংলাদেশ ও ভারতে বৃষ্টি শুরু হয়। একারণে মেঘনা অববাহিকায় সুরমা-কুশিয়ারাসহ অন্যান্য নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সংশ্লিষ্ট অববাহিকা সংলগ্ন নিম্নাঞ্চল ও বাঁধের বাইরে বন্যা দেখা দেয়। এর ফলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ইত্যাদি জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। অন্যদিকে, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ী অববাহিকার বাংলাদেশ ও ভারতের উজানের বিস্তৃৃত অংশে টানা মৌসুমি বর্ষণসহ অতি ভারী বর্ষণের প্রভাবে হালদা, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, মুহুরি, তিতাস নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর ফলে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, বান্দরবন এবং ফেনী ইত্যাদি জেলায় বন্যা দেখা দেয়।
বাংলা৭১নিউজ: বন্যা থেকে পরিত্রাণের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
পাউবো মহাপরিচালক: দেখুন, বিগত বছরগুলোর মতোই পানি উন্নয়ন বোর্ড অনুন্নয়ন রাজস্ব বাজেটের আওতায় বাঁধ ও অন্যান্য পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় মেরামত কাজ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এটি একটি অপ্রতুল ব্যবস্থা। এখানে অর্থের কারণে অনেক সময় কাজের গতি স্লথ হয়ে যায়।
বর্তমানে বন্যা জনিত ক্ষয়ক্ষতি সহনীয় মাত্রায় ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে বিবেচনায় নিয়ে সম্পদের সমন্বিত টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এটি করা হয়েছে রূপকল্প ২০৪১ ও ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে। একারণে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী বেসিন, তিস্তা নদী বেসিন, গঙ্গা-পদ্মা নদী বেসিন, আপার মেঘনা বেসিন (সুরমা-কুশিয়ারা নদী বেসিন সহ), লোয়ার মেঘনা বেসিন, কর্ণফুলী নদী বেসিন (হালদা নদী বেসিন সহ), সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদী বেসিনভিত্তিক সমীক্ষা সম্পাদন করা হচ্ছে। এ সমস্ত সমীক্ষা রিপোর্টের সুপারিশের আলোকে পানি সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার লক্ষে বিনিয়োগ প্রকল্প গ্রহন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভুমিকা রাখার পাশাপাশি অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে।
তিনি বলেন, পাউবো’র দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় দেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীসমূহকে একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে আনা হবে। ছোট নদ-নদী, খাল ও জলাশয়সমূহকে খননের মাধ্যমে পানি ধারন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বন্যার প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।
একই সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের নদ-নদীগুলোকে মেগা ড্রেজিং এর মাধ্যমে এর নাব্যতা ধরে রাখার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। যাতে করে বর্ষা মৌসুমের পানিকে ধরে রেখে শুষ্ক মৌসুমে কৃষি কাজে লাগানো সম্ভব হয়। এতে করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা সহ সরকারের রূপকল্প-২০৪১ ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে সেই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।
বাংলা৭১নিউজ: জরুরি কাজের বরাদ্দের অপ্রতুলতা নিয়ে ঠিকাদরদেও অনেক অভিযোগ, এটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন এবং সমাধান কি?
পাউবো মহাপরিচালক: দেখুন, যার সমস্যা আছে; তার সমাধানও আছে। আমাদের যে অনুন্নয়ন বাজেট থাকে সেখান থেকে আমরা ২০ পার্সেন্ট টাকা ইমারজেন্সি কাজে খরচ করতে পারি। এবার আমাদের অনুন্নয়ন খাতে ৭০০ কোটি টাকা আছে। এখান থেকে আমরা বছরে ১৪০ কোটি টাকা খরচ করতে পারবো। কোন কোন বছরে আমাদের ব্যয়ের পরিমানটা বৃদ্ধি পায়। ইমারজেন্সি কাজে কত টাকা ব্যয় হবে তা আমরা বুঝতে পারি পরবর্তি বছরে যেয়ে। মূলত ইমারজেন্সি কাজ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় আসলে জুন, জুলাই, আগস্টে। সময়টি এমন যে, একটি আর্থিক বছরের শেষ এবং আরেকটি আর্থিক বছরের শুরু। এজন্যই প্রয়োজনটা পরের বছরে যেয়ে স্পষ্ট হয়। তবে এটা ঠিক যে, সব সময়ই আমাদের এখাতে কিছু বাজেট ঘাটতি থাকে। এটা আমরা পরবর্তি বছর চাহিদা দিয়ে পূরণ করি।
ভিশন ২০২১: অভিযোগ রয়েছে ৬৪ জেলার নদ-খাল খনন প্রকল্প অর্থনৈতিক মন্দার কবলে, এ ব্যপারে আপনার অভিমত কি?
পাউবো পাউবো মহাপরিচালক: এই প্রকল্পে কোন অর্থ সংকট নেই। সরকার চাহিদা মোতাবেক প্রকল্পে অর্থ যোগান দিচ্ছে। সারাদেশেই ৬৪ জেলায় খাল ও নদী পুন:খননের কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক। তিনি বলেন, এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে- ৬৪ জেলায় খাল, জলাশয় ও ছোট নদীগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধি, পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো, গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জ ও জীব-বৈচিত্র সংরক্ষণের লক্ষ্যে ব-দ্বীপ প্রকল্প ২১০০ বাস্তবায়ন করা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার পাশাপাশি নিশ্চিত হবে দীর্ঘমেয়াদী পানি ব্যবস্থাপনা ও খাদ্য নিরাপত্তা। তিনি বলেন, এই প্রকল্পের আওতায় গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে- উপকূলীয় এলাকা, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নদী ও মোহনা এবং নগর অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনসহ একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২ হাজার ২৭৯ কোটি ৫৪ লাখ ৬১ হাজার টাকা। প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে প্রায় ৮৮টি ছোট নদী, ৩৫২টি খাল ও ৮টি জলাশয় খননের কাজ চলছে। এর ফলে ৫ লাখ ২০ হাজার হেক্টর এলাকা জলাবদ্ধতা ও বন্যার প্রকোপ থেকে রক্ষা পাবে। ফসলী জমিতে সেচের সুবিধা পাবে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমি। আর ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। এ ছাড়াও নৌ-চলাচলের সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার।
বাংলা৭১নিউজ: আপনাদের বেশ কয়েকটি সেচ প্রকল্প রয়েছে। এগুলো শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে ধুঁকে। এই সমস্যা মোকাবেলায় কী ধরণের উদ্যোগ নিচ্ছেন?
পাউবো মহাপরিচালক: আমাদের অনেকগুলো বড় বড় সেচ প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে যেমন মহুরি সেচ প্রকল্পে ১৭ হাজার ৯শ’ হেক্টর এলাকা সেচের আওতাধীন ছিল। মাঝে নাব্যতা কমায়, রিজার্ভারে পানির পরিমান কমে যাওয়ায় এবং খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় সমস্যা দেখা দেয়। তবে এই সম্যা সমাধানে ইরিগেশেন ম্যানেজমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (ইমিপ) নামক একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে খালগুলোকে সচল করতে খনন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এতে করে পানির ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এর মধ্যে দিয়ে আমরা পূর্বে যে সেচযোগ্য জমির পরিমান ছিল সেখানে চলে যেতে পারবো। মেঘনা ধনাগোদা প্রকল্পে সেচযোগ্য জমি যে পরিমান ছিল, ওই পরিমান জমিতেই চাষ হচ্ছে। এতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। মনু নদী নির্ভর যে সেচ প্রকল্প রয়েছে সেটিও ঠিক আছে। মূল সমস্যা হচ্ছে গঙ্গা এবং তিস্তা নদী নির্ভর সেচ প্রকল্পে।
এখন আমরা যেটা করছি এসব প্রকল্প এলাকার খাল এবং নদীগুলো খনন করে এর ধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে দিচ্ছি। এই ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর ফলে মেঘনা-ধনোগোদা, কিংবা জিকে প্রকল্পে প্রথম যে পরিমান পানি লাগতো তার চেয়ে বেশি পানি এখন আমরা দিতে সক্ষম হয়েছি। এতে ফসলের পরিবর্তন আসলেও নদী এবং খাল খননের মাধ্যমে পানির বাড়তি চাহিদাটা পূরণ করা সম্ভব। সেইসাথে চেষ্টা চলছে পানি ব্যবস্থার দক্ষতা বাড়ানো এবং পানির অপব্যবহার রোধ করা। এই অপব্যবহার ঠেকাতে কার্ডের মাধ্যমে পানি দেওয়া। যেটা আমরা মহুরি সেচ প্রকল্পে শুরু করবো। কার্ডের মাধ্যমে কৃষক পানি নেবে এবং পয়সা দিয়ে ক্রয় করবে। এখন যেমন একেবারেই বিনামূল্যে নেওয়ায় যে পরিমান পানির প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি নিয়ে যাচ্ছে। এরফলে পানির অপব্যবহার বাড়ছে, অন্যদিকে সেচ খালের শেষ মাথায় কৃষক পানি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রিপেইড মিটারের মাধ্যমে নিলে পানির এই অপব্যবহার রোধ করা যাবে। এই কনসেপ্ট আমরা আস্তে আস্তে সব ইরিগেশন প্রকল্পেই নিয়ে আসবো। কিছু কিছু এলাকায় আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ লাইনেও চলে যাচ্ছি। আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ লাইনে গেলে পানি অপব্যবহার কম হবে। আবার কিছু কিছু এলাকায় যেখানে টারশিয়ারি ক্যানেল আছে সেগুলিকে আমরা আরসিসি ক্যানেলের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। যেটা আমরা তিস্তায় করবো। এটা করলে পানির অপব্যয়টা কম হবে এবং একই পানি দিয়ে প্রায় দেড়গুন এলাকা ইরিগেশন করতে পারবো। আমাদের মাথায় এই চিন্তা আছে যে, ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ হলেও কোথায় যাতে খাদ্য ঘাটতি দেখা না দেয়। বিশ কোটি মানুষকে খাওয়ানোর জন্য যে পরিমান খাদ্য দরকার তা উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত সেচের পানি যেন থাকে এটাকে মাথায় রেখেই আমরা ইরগেশন প্রজেক্টগুলোকে পূনর্বাসনের দিকে নিচ্ছি।
বাংলা৭১নিউজ: সীমান্ত নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধে আপনারা কী ধরণের উদ্যোগ নিয়েছেন এবং অভিন্ন নদীর কাজ করার ক্ষেত্রে যে বাধা আসে তা কীভাবে মোকাবেলা করছেন?
পাউবো মহাপরিচালক: সীমান্ত নদী ভাঙ্গন রক্ষায় আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি। এটি হচ্ছে সীমান্ত নদী তীর রক্ষা প্রকল্প। আগে যেটি ছিল-অনেক সময় সীমান্তে কাজ করতে গেলে প্রতিরোধ আসে। কখনো কখনো এরকম প্রতিরোধ এসেছে। এতে করে আমাদেরকে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে। পরবর্তিতে আমরা যেটি করলাম, সীমান্ত নদীর প্রথম ফেইজ যখন আমরা বাস্তবায়ন করি তখন আমরা যৌথ নদী কমিশন বাংলাদেশ এবং ভারতের সাথে আলোচনার পর আমরা দু’দেশের নদী তীর ভাঙ্গন এলাকাগুলো চিহ্নিত করি। এরপর দুুইদেশ একমত হলো যে, এই নদীগুলোর তীর প্রতিরক্ষা কাজ করা দরকার। সেইভাবে প্রথম পর্যায়ের কাজ আমরা শেষ করে ফেলেছি। একইভাবে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের ক্ষেত্রেও আমরা উভয় দেশ আলোচনার মধ্যে দিয়ে চলমান রেখেছি।
এরপরও যদি কোথায় ভাঙ্গন দেখা দেয় তাহলে যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে আমরা বিষয়টি ভারতকে অবহিত করি এবং পারস্পরিক বুঝাপরার মাধ্যমেই আমরা কাজটি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। দেখুন, আমাদের প্রথম লক্ষ্য থাকে সীমান্ত নদী ভাঙ্গনে যাতে আমাদের কোন ভূখন্ড হারাতে না হয়। কারণ আমাদের সবগুলো সীমান্ত নদী সীমানা এখনও চিহ্নিত হয়নি। সেক্ষেত্রে সীমান্ত নদীর সীমানা ধরা হয় নদীর মধ্য রেখা বরাবার। এবিষয়গুলো আমরা মাথায় রেখেই কাজ করি। এরপরও কোন প্রয়োজন হলে দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বৈঠকে বসছে। আরও উপরের প্রয়োজন হলে আমরা যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে বিষয়টি ভারত সরকারের দৃষ্টিতে নিয়ে যাচ্ছি। কাজেই সীমান্ত নদীতে কাজ করার ক্ষেত্রে তেমন কোন বাধা এখন আমরা পাচ্ছি না। সুসম্পর্কের ভিত্তিতেই আমরা সীমান্ত নদী তীর ভাঙ্গন প্রতিরোধের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এরপরও কোন সমস্যা দেখা দিলে আমারা উভয় দেশ আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করছি।
বাংলা৭১নিউজ: পাউবো’র অনিয়ম, দূর্নীতি বন্ধে কী ধরণের পদক্ষেপ নেবেন?
পাউবো মহাপরিচালক: অনিয়মগুলো অতিতে হতো দরপত্র নিয়ে। এখনতো সমস্ত দরপত্র ই-টেন্ডার। এই ই-টেন্ডার কন্ট্রোল করা হয় সিপিটিইউ থেকে। এটা পাউবো কিংবা অন্য কোন সংস্থার হাতে নেই। যে কারণে সব তথ্য ইলেকট্রিক্যালি সবার কাছে ওপেন। এধরণের টেন্ডার প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর অনিয়ম অনেক কমে গেছে। আরেকটি হচ্ছে-মাঠ পর্যায়ের কাজে আমরা সর্বোস্তরে মনিটরিং করছি। ব্যক্তিগতভাবে ্আমি, পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সচিব সবাই তদারকি করছি। সরাসরি আমরা ব্লক বানানো পর্যবেক্ষন করছি এবং ক্রুটিপূর্ন মালামাল বাতিল করে দিচ্ছি। আমরা এমনটি করছি-ভবিষ্যতের বাংলাদেশ যাতে আরও সুন্দর হয়। নদী তীরে নেদারল্যান্ড কাজ করলে যেমন সকলে তাকিয়ে থাকে, বাংলাদেশও নদী তীর সংরক্ষণের কাজ করলে যাতে ওইভাবে তাকিয়ে দেখে বলতে পারে যে কাজটি সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন হয়েছে। এভাবে আমরা অনিয়ম ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের মাঠ প্রশাসনকে মোটিভেশন করছি। আমরা বলছি, এই কাজটা আমার নিজের কাজ, আমার দেশের কাজ। এটা আমাকে ভাল ভাবে করতে হবে। এতে করে পাউবো কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে এক ধরণের সচেতনতা তৈরি হয়েছে এবং আমরা অনেক ভাল ফল পাচ্ছি। অর্থাৎ অনিয়ম, দূর্নীতি আর আগের মত নেই বললেই চলে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আমরা সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনাকে আমরা এগিয়ে নিতে পারবো।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচবি