বাংলা৭১নিউজ, ঢাকা: রাজধানীর পশ্চিম নাখালপাড়ার ‘জঙ্গি আস্তানায়’ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) অভিযান যখন শুরু হয়, তখন ভবনটির বাসিন্দাদের প্রায় সবাই ছিলেন ঘুমে। আশপাশের এলাকাও তখন নিস্তব্ধ, কুয়াশার চাদরে ঢাকা। গভীর রাতে কুয়াশা ভেদ করে হঠাৎ করেই গুলির শব্দে গোটা এলাকা কেঁপে ওঠে।
মানুষজন ভয়ের মধ্যে পরিস্থিতি আঁচ করার চেষ্টা করেন। আশপাশের পরিচিতজনকে ফোন করে বিষয়টি জানার চেষ্টা করেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টা থেকে ১৩/১ পশ্চিম নাখালপাড়ার ‘রুবি ভিলা’ নামে ওই বাড়িটি ঘিরে অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ভবনটির মালিক সাব্বির হোসেন। তিনি বিমানবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন।
ভবনটির পাঁচতলার একটি কক্ষেই ‘জঙ্গি আস্তানা’ বলে জানিয়েছে র্যাব। ওই ভবনে মেস করেও শিক্ষার্থী ও অন্যরা থাকেন। ষষ্ঠতলার এ রকম একটি কক্ষে থাকেন গাজীপুরের পারভেজ নামের এক যুবক। তিনি অভিযান শুরুর পর পরই বাবা কামরান হোসেনকে ফোন করে পরিস্থিতি জানান।
কামরান ছেলের ফোন পেয়েই ঢাকায় ছুটে এসেছেন। কিন্তু ছেলের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছেন না। ছেলের ফোনও বন্ধ পাচ্ছেন সকাল থেকে। ‘রুবি ভিলা’য় প্রবেশের চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হন। ফলে ওই বাড়ির আশপাশেই ছেলের সন্ধানে ঘুরছেন কামরান।
বেলা ১১টার দিকে ‘রুবি ভিলা’র পাশের একটি গলিতে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় কামরানের। তিনি বলেন, ‘রাত আনুমানিক ৩টার দিকে ছেলে ফোন দিচ্ছে। দিয়ে বলে, আব্বা, বাসায় খুব গোলাগুলি হচ্ছে। কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। বাসা র্যাব আর পুলিশ ঘিরে রেখেছে।’
‘বাসায় খুব গোলাগুলি হচ্ছে। আব্বা, বাঁচব কি না জানি না, আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসেন।’
‘এর পরই আমি বাড়ি থেকে রওনা দিছি’, যোগ করেন কামরান। তিনি আরো বলেন, এখানে আসার পর ছেলের মোবাইল বন্ধ পাচ্ছি। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না।
পশ্চিম নাখালপাড়ার যে ছয়তলা বাড়িটি ঘিরে এ অভিযান চলছে, সেটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এই ভবনটি ছাপড়া মসজিদের পাশে। ভবনের উত্তর দিকে রয়েছে সংসদ সদস্যদের আবাসিক ভবন। বাড়িটির পাঁচতলায় একটি মেস করে জঙ্গিরা অবস্থান করছিল বলে র্যাব প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে। সেখানে তাঁরা উঠেছিল এক সপ্তাহ আগে। তবে তাঁরা ভুয়া আইডি ব্যবহার করেছিল বলে সন্দেহ করছে র্যাব।
সকাল ১০টার দিকে র্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমদ জানান, নিহত তিনজনের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে হবে। সেখান থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে।
র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ জানান, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে রাত ২টা থেকে বাড়িটি ঘিরে রেখে অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ভবন থেকে অন্য বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে কয়েকজনকে।
এ অভিযান সম্পর্কে সকালে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
‘রুবি ভিলা’র পাশের ভবনে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন নাছির আহমেদ (৩০)। তিনি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘রাতে ঘুমানোর পর হঠাৎ গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। তখন রাত প্রায় দুইটা-আড়াইটা হবে। তিন থেকে চারটি গুলি হয়।’
‘কিছু পরে মাইকিং শুনতে পাই, বলতেছে যে, আপনারা আত্মসমর্পণ করুন। এ রকম আধাঘণ্টা ধরে চলছে’, যোগ করেন নাছির।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পশ্চিম নাখালপাড়ার এক ষাটোর্ধ্ব নারী জানান, তাঁর জন্ম এখানেই। এক বছর আগেও এই ভবন থেকে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায় তেজগাঁও থানার পুলিশ। পরে তাঁরা জেনেছিলেন, তাদের জঙ্গি সন্দেহেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
পশ্চিম নাখালপাড়া শেষ হলেই শুরু পূর্ব তেজকুনিপাড়া। সেখানকার বাসিন্দা (৪০) এক যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সেখানে তাঁর একটি মোবাইল রিচার্জের দোকান আছে। পেছনে পরিবার নিয়ে তিনি থাকেন।
ওই যুবক বলেন, ‘রাত দেড়টা-দুইটা হবে মনে হয়, হঠাৎ চার-পাঁচটা গুলির শব্দ পাইছি। তারপর বের হয়ে দেখি কিছু নাই। পরে ভয়ে ভয়ে গিয়ে আবার শুয়ে পড়েছি। এর একটু পরেই মাইকিং শুনি, বলে—আত্মসমর্পণ করেন।’
গত ২০ বছর ধরে ওই এলাকায় আছেন এমন পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি জানান, তিনিও রাতে গুলির শব্দে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। তবে মাইকিংয়ের আওয়াজ শুনলেও স্পষ্ট করে কোনো কথা শুনতে পাননি। নিজের নাম-পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
বাংলা৭১নিউজ/এসএস