বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশি বর্বরতায় সরাসরি রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। তারা বেশকিছু উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। সোমবার প্রকাশিত এক রিপোর্টে এসব জানিয়েছে সংস্থাটি।
গত বছরের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা অফিসারদের চেয়ে রাজনৈতিক নেতারাই বেশি ঠিক করে দিতেন বলে জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ। ৫০ পাতার রিপোর্টে পুলিশের বয়ানে উঠে এসেছে সেসময়কার নির্দেশদাতা এবং অপরাধের নমুনা।
‘আফটার দ্য মনসুন রেভোলিউশন: এ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। জানানো হয়েছে, অতীতে কীভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং নিরাপত্তা বাহিনী সবসময় রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের নানা দিকও উঠে এসেছে প্রতিবেদনটিতে।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা এইচআরডব্লিউকে জানিয়েছেন, জুলাই-আগস্টের বিদ্রোহের সময় অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকেই এসেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, অস্থিরতার সময় পুলিশের ভূমিকা মাঠপর্যায়ের অফিসারদের চেয়ে রাজনৈতিক নেতারাই বেশি নির্ধারণ করে দিতেন।’
আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তা এইচআরডব্লিউকে বলেছেন, তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের সিনিয়র অফিসারদের লাইভ সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে দেখেছেন এবং প্রতিবাদকারীদের গুলি করার জন্য অফিসারদের সরাসরি এমনভাবে নির্দেশ দিতে দেখেছেন যেন ‘তারা কাউকে ভিডিও গেমে গুলি করার নির্দেশ দিচ্ছেন।’
আন্দোলনের সময় ১৮ বছর বয়সি আমির হোসেন পুলিশের হাতে ধরা পরে। এসময় তারা বিল্ডিং থেকে লাফ দিতে বলে। হিউম্যান রাইট ওয়াচকে আমির বলেছেন, ‘পুলিশ যখন আমার দিকে আসছিল, তখন ধরা পড়ে যাবার ভয়ে আমি নির্মানাধীন একটা বিল্ডিংয়ে উঠি। যখন আমি চারতলায় পৌঁছাই তখন পুলিশ আমাকে লাফ দিতে বলে। আমি জানি যদি এখান থেকে পরে যাই তবে, আমি মারা যাব।
চারতলায় তাই একটি রডে ঝুলে থাকার চেষ্টা করি। একজন পুলিশ অফিসার আমার দিকে ছয় রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। ততক্ষণে আমি তিন তলার ঝুলছিলাম। এসময় অনেক পুলিশ আমার পায়ে আঘাত করছিল। পরে তারা চলে যায়। আমার তখন অনেক ব্যথা হচ্ছিল। বাধ্য হয়ে তিনতলা থেকে লাফ দেই। তখন আমার একটি পা ভেঙে যায়। আমি এখনও বুঝতে পারি না কেন তারা আমাকে ধাওয়া করে গুলি করল!’
গুলি করার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা। বাংলাদেশ পুলিশের একজন অফিসার বলেছেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদেরকে কঠোর হতে এবং ‘নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কোনও অপরাধী’কে রেহাই না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারা স্পষ্টভাবে ‘গুলি করো’ শব্দটি ব্যবহার করেননি, তবে তাদের নির্দেশাবলী স্পষ্ট ছিল: সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করুন, আপনি যা প্রয়োজন মনে করেন তা করুন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান নিন।’
তিনি এইচআরডব্লিউকে বলেন, আন্দোলনের সময়কার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আন্দোলন চলাকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকেও সরাসরি পুলিশের বর্বরতার সাক্ষী হতে দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আগস্টে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক কর্মকর্তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলছেন, ‘গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা…বাকিডি যায় না স্যার।’
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ