আজ ১১ ডিসেম্বর। টাঙ্গাইল হানাদারমুক্ত দিবস। ৫০ বছর আগে এই দিনটি টাঙ্গাইলবাসীর জন্য এনেছিল বিজয়ের বার্তা। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার মুক্তিকামী সূর্যসেনারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে টাঙ্গাইলকে মুক্ত করে উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে এই দিনে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও পলায়নের মধ্য দিয়ে হানাদারমুক্ত হয়েছিল টাঙ্গাইল। সারারাত মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণ ও গোলাগুলিতে বিনিদ্র রাত কাটায় শহর ও শহরতলির লোকজন। অবশেষে ১১ ডিসেম্বর সেই কাঙ্খিত মুহূর্তটি আসে।
স্বজন হারানোর ব্যথা ভুলে হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতা রাস্তায় নেমে আসে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান তুলে মুক্তির সেই আনন্দে শামিল হয় জনতা। যুদ্ধকালীন সময়ে টাঙ্গাইলের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার কাহিনী দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত ও পরিচালিত ‘কাদেরিয়া বাহিনীর’ বীরত্বের কথা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।
৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে আদালতপাড়ার অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামের বাসভবনে গঠিত হয় টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীনবাংলা গণমুক্তি পরিষদ। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে আাহ্বায়ক ও সশস্ত্র গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং বদিউজ্জামান খানকে চেয়ারম্যান ও আব্দুল কাদের সিদ্দিকীসহ আরও আটজনকে সদস্য করে কমিটি গঠন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আব্দুল মান্নান, টাঙ্গাইল, জামালপুর এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত এমপি শামছুর রহমান খান শাজাহান ছিলেন অগ্রগণ্য। একপর্যায়ে টাঙ্গাইলে গঠন করা হয় কাদেরিয়া বাহিনী। এই বাহিনীর প্রতিরোধ ও প্রত্যাঘাত শুরু করে পাক সেনাদের ওপর। ক্রমান্বয়ে সংগঠিত হতে থাকে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের অল্প দিনের মধ্যেই কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী।
এ বাহিনীর সদস্য ১৭ হাজারে উন্নীত হয়। এছাড়া ১৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও কাদেরিয়া বাহিনীর সহযোগী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শুরু হয় বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কাদেরিয়া বাহিনীর যুদ্ধ। এ সময় পাক হানাদারদের কাছে আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ‘বাঘা সিদ্দিকী’ নামে এক মহাতঙ্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। এছাড়াও টাঙ্গাইলে খন্দকার আব্দুল বাতেন বাহিনীর নেতৃত্বে গঠিত ‘বাতেন বাহিনী’ অনেক জায়গায় হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
চারদিক থেকে আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকবাহিনী।১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলে প্রায় ৫ হাজার পাক সেনা এবং ৭ হাজার রাজাকার আলবদর অবস্থান করে। খান সেনাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য যমুনা নদী পথে পাঠানো হয় সাতটি জাহাজ ভর্তি অস্ত্র ও গোলাবারুদ। কাদেরিয়া বাহিনী গোপনে এই খবর পেয়ে কমান্ডার হাবিবুর রহমানকে দায়িত্ব দেয় জাহাজ ধ্বংস করার জন্য মাইন পোতার কাজে। জীবন বাজি রেখে মাটিকাটা নামক স্থানে ঘটানো হয় জাহাজ বিস্ফোরণ।
দুটি জাহাজে দুই রাত দুই দিন ধরে চলতে থাকে অনবরত বিস্ফোরণ। বাকি জাহাজগুলো থেকে বিপুল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় জেলার বিভিন্ন স্থানে। মুক্তিবাহিনীর এ সকল আক্রমণ ও গোলাবারুদ ধ্বংস এবং অস্ত্র উদ্ধারে খান সেনারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এপ্রিল থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পর্যদুস্ত করে খান সেনাদের। এসব যুদ্ধে তিন শতাধিক দেশপ্রেমিক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
মুক্তিযোদ্ধাদের টাঙ্গাইল অঞ্চলের প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যোদ্ধাদের নিয়ে সখিপুরের মহানন্দা ও কীর্তনখোলায় গড়ে তুলেন দুর্ভেদ্য দুর্গ। একের পর এক আক্রমণের মুখে পাক সেনারা গুটিয়ে জেলার অন্যান্য স্থান থেকে এসে যখন টাঙ্গাইল শহরে অবস্থান নেয় তখন উত্তর ও দক্ষিণ টাঙ্গাইল ছিল সম্পূর্ণ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ৮ ডিসেম্বর পরিকল্পনা করা হয় টাঙ্গাইল আক্রমণের। মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয় পাক সেনাদের পুংলি নামক স্থানে।
অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাণভয়ে পাক সেনারা সারারাত ধরে টাঙ্গাইল ছেড়ে ঢাকার দিকে পালায়।পরিকল্পনা অনুযায়ী চার দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে পাক সেনাদের টাঙ্গাইল থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয় কাদেরিয়া বাহিনী। ১০ ডিসেম্বর রাতে টাঙ্গাইল প্রবেশ করেন কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক ভোলা।১১ ডিসেম্বর সকালে কমান্ডার বায়েজিদ ও খন্দকার আনোয়ার টাঙ্গাইল পৌঁছেন।
আসেন বিগ্রেডিয়ার ফজলুর রহমান। সার্কিট হাউজে অবস্থানরত খান সেনারা কাদের সিদ্দিকীর কাছে আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয় টাঙ্গাইল।মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কাদেরিয়া বাহিনীর ১৫৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৫০০ জন আহত হন। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এ বাহিনী থেকে ১৭ জন রাষ্ট্রীয় খেতাব পান।দিবসটি পালনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে টাঙ্গাইলে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।কর্মসূচিতে মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনসহ সকল রাজনৈতিক এবং সরকারি-বেসরকারি সংগঠন অংশগ্রহণ করবে।
বাংলা৭১নিউজ/আরকে