বাংলা৭১নিউজ,ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানো এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, যারাই জনগণকে পোড়াবে জনগণই তাদেরকে প্রতিহত করবে।
জানুয়ারি থেকে মার্চ সরকার পতনের আন্দোলনের নামে টানা ৯২ দিন বিএনপি-জামাতের সন্ত্রাসের প্রসঙ্গ এনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তখন বেগম জিয়া বলেছিলেন, সরকার উৎখাত না করে নাকি ঘরে ফিরবেন না-সরকার উৎখাত করতে পারেনি। জনগণই ঠেকিয়েছিল তাদেরকে। যারাই জনগণকে পোড়াবে জনগণই তাদেরকে প্রতিহত করবে। ভবিষ্যতেও তাদেরকে জনগণই ঠেকাবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা একটা কথায়ই বিশ্বাস করি- আমরা স্বাধীনতা এনেছি। এই স্বাধীনতাকে আমাদের অর্থবহ করতে হবে। জাতির পিতাকে হত্যা করে জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করে, হাজার হাজার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীকে হত্যা করে তারা ভেবেছিল আওয়ামী লীগের নাম-নিশানা মুছে দেবে। কিন্তু এদেশের মাটি ও মানুষের কথা বলার মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগ সংগঠনটা চলে ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে রাজধানীর কৃষিবিদ মিলনায়তনে জেলহত্যা দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্মরণ সভায় সভাপতির বক্তৃতায় এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা দৃঢ় কন্ঠে বলেন, এটা কোন উড়ে এসে জুড়ে বসা অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীর দল নয়, এই দলের শিকড় বাংলার মাটিতে প্রোথিত। এই দল আওয়ামী লীগকে হাজারো ষড়যন্ত্র করেও কেউ কোনদিন নিশ্চিহ্ন করতে পারে নাই। ইনশাল্লাহ আগামীতেও পারবে না।
প্রধানমন্ত্রী বিএনপি’র উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তারা ২০১৪ সালের নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করে এবং খালেদা জিয়া নিজেই নির্বাচনে আসে নাই। রাজনীতিতে ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত তাদেরকেই (সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল) দিতে হয়।’
‘অথচ খালেদা জিয়া তার ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতিশোধ নিতে গেল জনগণের ওপর। জনগণ কেন ভুলের খেসারত দেবে,’ প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী।
স্মরণ সভায় জাতীয় সংসদের উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সভাপতি মন্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও ড. আব্দুর রাজ্জাক বক্তৃতা করেন।
স্মরণ সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদের পরিচালনায় স্মরণ সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন- আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দিন আহমদের কন্যা সিমিন হোসেন রিমি এমপি এবং মহানগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণ ও উত্তরের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ ও সাদেক খান।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ১৫ আগস্টের শহীদ, প্রয়াত জাতীয় চারনেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ স্মরণে দাঁড়িয়ে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের অনুরোধ করব, এই স্বাধীনতার ইতিহাস, আমাদের অর্জনের ইতিহাস, গৌরবের ইতিহাস, বিজয়ের ইতিহাস- যে ইতিহাসকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল তা আগামী প্রজন্মের সবাই যেন জানতে পারে। নিজেদেরকে গড়ে তুলতে পারে। সেইভাবেই আমাদেরকে কাজ করে যেতে হবে। জাতির পিতা এই দেশ দিয়ে গেছেন আমরা বিশ্ব সভায় এই দেশকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে চাই। সেটাই আমাদের লক্ষ্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী যে চেতনা জেগে উঠেছে তাকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
তিনি তাঁর জঙ্গিবিরোধী অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘দেশে কোন সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থাকতে দেব না এবং তাদের মদদকারিরাও সাজা পাবে।’
এ প্রসঙ্গে তিনি সম্প্রতি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের টেস্ট জয়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা যে পারি এটাও তার একটা নমুনা। আমরা জোর প্রচেষ্টা নিলে বিশ্বের সেরাদেরকেও পরাভূত করতে পারি।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ঘটনা ছিল মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের দালালদের চরম প্রতিশোধ। পরাজিত শক্তির লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
তিনি বলেন, ‘এসব হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে যাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় বাংলাদেশ আর এগোতে না পারে। যাতে আওয়ামী লীগ আর কোনোদিন ক্ষমতায় আসতে না পারে।
তিনি প্রশ্ন করেন, ‘এসব হত্যার পর কারা ক্ষমতায় এসেছে ? পাকিস্তানের দালালরা এখানে ক্ষমতায় এসেছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের পথ চিনিয়ে গ্রামে গ্রামে নিয়ে গেছে, এ দেশের মা-বোনদের তাদের হাতে তুলে দিয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেতারা নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে কথা বলে। নির্বাচন কমিশনের গঠন নিয়ে কথা বলে। আমি তাদের বলবো, অতীত ইতিহাস যেন তারা দেখে। তাদের নেতা জিয়াউর রহমান কী করে গেছেন, খালেদা জিয়া কী করেছেন। দেশে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পালা শুরু করেছিলেন জিয়াউর রহমান। পরে তাদের দোসর এরশাদ তা অনুসরণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেতারা যখন গণতন্ত্রের কথা বলে, মানবাধিকারের কথা বলে, হত্যা-গুম খুনের কথা বলে তখন মনে হয় তারা আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখে না।
‘আর যদিও বা দেখে তাহলে মেকআপ করার বাইরে আর কিছ্ইু দেখতে পায় না,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী।
জিয়া সেনাবাহিনী প্রধান থাকাবস্থায় ক্যান্টনমেন্টে বিএনপির জন্ম হয় এমন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সামরিক সরকারের উচ্ছিষ্ট ভোগ করে যে রাজনৈতিক দলের জন্ম তারা কিভাবে দেশের উন্নয়ন করবে। তাইতো আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন দেশের উন্নয়ন হয়। কেন হয়, আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করি বলেই দেশের এত উন্নয়ন হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার পর ২১ বছর এই বাংলাদেশ শোষিত হয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে। সমগ্র বাংলাদেশ ছিল একটা কারাগার।
তিনি বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর খুনি মোশতাক কিছুদিনের জন্য রাষ্ট্রপতি হয়। সে এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত। জিয়াউর রহমান আরেক খুনি, সেও এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত। কারণ মোস্তাককে সরিয়ে সুযোগ বুঝে ঘটনার মূল নায়ক জিয়া পরে মিলিটারি আইন ভঙ্গ করে রাষ্ট্রপতিই হয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দপঁচাত্তরের আত্মস্বীকৃত খুনিরা বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছে, জিয়ার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল, সে ইশারা দিয়েছিল। খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরী দিয়ে জিয়াই পুরস্কৃত করে।’
প্রধানমন্ত্রী জিয়ার সে সময়ে গণমাধ্যমে রাষ্ট্রপতি হবার সংবাদ প্রচারের কথা উল্লেখ করে বলেন বলেন,‘তিনি ঘোষণা দেন-আজ থেকে আমি রাষ্ট্রপতি হলাম। একদিকে রাষ্ট্রপতি অন্যদিকে সামরিক প্রধান।’
‘যখন থেকে জিয়া ক্ষমতায় এসেছে, দেশে প্রতি রাতে কারফিউ ছিল। কারফিউ গণতন্ত্র দিয়েছিল জিয়া। নির্বাচনকে কালো অধ্যায় করেছিল,’বলেন প্রধানমন্ত্রী।
জিয়াউর রহমানের তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসে যেভাবে চেয়েছে, সেভাবেই নির্বাচনের রেজাল্ট হয়েছে। নির্বাচনকে নিয়ে খেলা তো সেখান থেকেই শুরু। জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে তাদের যে ছিনিমিনি খেলা, হ্যাঁ-না ভোট রেফারেন্ডাম, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন- প্রতিটি নির্বাচন ছিল প্রহসনের খেলা। সেখানে নির্বাচনে ভোট দেয়ার অধিকার কারও ছিল না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা যুদ্ধাপরাধী, তাদের ভোটের অধিকার ছিল না। মার্শাল ’ল’ অর্ডিনেন্সের মাধ্যমে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের কিছু অংশ সংশোধন করে জিয়া তাদের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে। ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে রাজনীতি ও দল করার সুযোগ দিয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে আনেন জিয়া মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯টি ক্যু হয়েছে। একেকটি ক্যু হওয়া মানেই সামরিক বাহিনীর অফিসার ও সৈনিকদের জীবন নিয়ে খেলা। হাজার হাজার অফিসার, সৈনিকদের সে হত্যা করেছে।’
তিনি বলেন, ‘পঁচাত্তরের পরে আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। চার বছর পর্যন্ত তারা কারাগারে ছিলেন।
শেখ হাসিনা এ সময় জিয়ার মৃত্যুর পর তার বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া ভাঙ্গা স্যুটকেস ও ছেড়া গেঞ্জি দেখিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা হয় উল্লেখ করে সে সময় বেগম জিয়ার থাকা ৯০ লাখ টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের প্রসংগও উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘২০০১ সালে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ার দাসখত দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর আর দেশ ও জনগণের কথা চিন্তা না করে আত্মন্নয়নেই তারা সচেষ্ট হয়। খালেদা জিয়ার দুই ছেলের মানি লন্ডারিংয়ের মামলা যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের দুটি আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপি নেত্রী এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন বলেই আজ আদালতে গিয়ে নিজের মামলা মোকাবেলা করতে ভয় পান। তার আমলে পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ।’
‘বাংলা ভাই সৃষ্টি করে সরকারের মদদে প্রকাশ্যে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান সে সময় থেকেই’,বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বর্তমান সরকারের আমলে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন চিত্র তুলে বলেন, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল।
তিনি পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অবস্থানের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে নিজস্ব উদ্যোগেই পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রসংগ উল্লেখ করে বলেন,‘অপবাদ দিলেই আমরা অপবাদ নেই না। আমরা সেটা চ্যালেঞ্জ করি এবং আমরা চ্যালেঞ্জ করে সেটা দেখিয়ে দিয়েছি হ্যা বাংলাদেশ পারে। কারণ আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি আমরা আত্মমর্যাদা নিয়েই বাঁচব।’
শেখ হাসিনা বলেন, আজকে স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে চলার মত আত্মমর্যাদাটুকু আমাদের আছে। এই ক্ষমতাটুকু বাংলাদেশ অর্জন করেছে। এটার ধারাবহিকতাটা বজায় রাখতে হবে।
সরকারের ধারাবাহিকতাটা ছিল বলেই তার সরকার দেশের বর্তমান উন্নয়ন কর্মকান্ডগুলো করতে পেরেছে এবং ভবিষ্যতেও পারবে বলেও প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি এ সময় তার রাজনৈতিক অঙ্গীকার পূণর্ব্যক্ত করে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত ও সমৃদ্ধ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।
বাংলা৭১নিউজ/এন