বাংলা৭১নিউজ, রিপোর্ট: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে বিভিন্ন দল থেকে আসা নেতা-কর্মীদের নিয়ে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ক্রমেই বাড়ছে। এসব বহিরাগতদের অনেকেই অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িযে পড়ায় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে এসব অপকর্মের দায়ভারে বহন করতে হচ্ছে। এতে করে সরকার ও দল দুু’টোরই ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে ফেনীর সোনাগাজীর ঘটনা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদেরকেও নাড়া দিয়েছে।
খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোনাগাজীতে মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা এবং এই পৈশাচিক ঘটনার সাথে জড়িতদের শাস্তির ব্যপারে অনঢ় অবস্থান নিয়েছেন।তিনি নুসরাতের বাবা-মাকে ডেকে এনে সাক্ষাত করেছেন এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বলেছেন। এই ঘটনায় শেখ হাসিনা এতটাই মর্মামহ যে, তিনি নিজে সার্বক্ষনিক মৃত্যুর সাথে লড়ে যাওয়া চিকিৎসাধীন নুসরাতের খোঁজ রেখেছেন। আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নাসরিনের মৃত্যু সংবাদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছা মাত্র তার চোখের কোনায় পানি এসেছিল। তিনি নুসরাতের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন, তার ভাইকে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকুরিও দিয়েছেন।
কিন্ত যে জিনিষটি আওয়ামী লীগকে নতুন করে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে তা হচ্ছে- এসব অপরাধের সাথে আওয়ামী লীগের কারা জড়িত? দলের ভেতর থেকে আওয়াজ উঠেছে- আওয়ামী লীগে ঢুকে যাওয়া বহিরাগতরাই এসব অপরাধ বেশি করছে। ফলে বহিরাগত নেতা-কর্মীদের নিয়ে দলের অভ্যন্তরে একদিকে যেমন শঙ্কা বাড়ছে, অন্যদিকে বাড়ছে ক্ষোভ।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, গত দশ বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া বহিরাগত নেতা-কমীর সংখ্যা কত? প্রশ্নটা যে নতুন এমন নয়।এই শঙ্কা এবং দলের অভ্যন্তরে বহিরাগত এসব নেতা-কর্মীদের সাথে পোর খাওয়া আওয়ামী লীগের নিজস্ব নেতা-কর্মীদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব বেশ কয়েক বছর ধরেই চলে আসছে। এই দ্বন্দ্ব অনেক সময় প্রকাশ্যে বাক-বিতন্ডাতেও রূপ নিয়েছে। অনেক সিনিয়র নেতাই আক্ষেপের সুরে আওয়ামী লীগে ‘হাইব্রিড’ এবং ‘কাউয়া’ ঢুকেছে এমনসব মন্তব্য করেছেন।
‘আওয়ামী লীগে বহিরাগতদের নিয়ে উদ্বেগ, অন্য দল থেকে আসা নেতা-কর্মীদের তালিকা হচ্ছে’ শিরোনামে বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, গত বছরগুলোতে বিভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগে যোগদানকারিদের তালিকা তৈরি করে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
সম্প্রতি ফেনীর সোনাগাজিতে মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহানকে হত্যার ঘটনার সন্দেহভাজন কয়েকজনের সাথে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা থাকা নিয়ে যে সমালোচনা বিতর্ক হচ্ছে – সে প্রসঙ্গে দলের একজন শীর্ষ নেতা বলেন, অন্য দল থেকে আসা লোকজনকে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নুসরাত জাহাত হত্যায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তারকৃত স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে সোমবার পাঁচদিনের পুলিশ রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
পুলিশ বলেছে, প্রধান অভিযুক্ত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আগে জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও হালে তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করেছিলেন।
আওয়ামী লীগের তৃণমুলের নেতা কর্মীদের অনেকে বলেছেন, ক্ষমতার সুবিধা নিতে বিভিন্ন দল থেকে যোগদানকারির সংখ্যা উদ্বেজনক হারে বাড়ছে।
সোনাগাজিতে মাদ্রাসা ছাত্রীকে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত ১৩ জনের মধ্যে মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা সহ ১০জনকে ইতিমধ্যেই রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ সোনাগাজি পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাকসুদ আলমকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেয়া হলো।
সোনাগাজি আওয়ামী লীগের একজন নেত্রী মর্জিনা আকতার বলছিলেন, সাবেক জামায়াত নেতা সিরাজউদ্দৌলা স্থানীয় আওয়ামী লীগের দু’এক জনের সাথে যোগসাজশ করে চলতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আওয়ামী লীগকেই অস্বস্তিতে ফেলেছে বলে তিনি মনে করেন।
যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা সোনাগাজির হত্যারকান্ডের ঘটনায় জড়িতদের কাউকে ছাড় না দিয়ে তাদের অপরাধী হিসেবে দেখার কথা বলছেন।কিন্তু সোনাগাজির ঘটনার প্রেক্ষাপটে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগে যোগদানকারিদের নিয়ে দলটির নেতা কর্মিদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে বলে মনে হয়।
বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে আওয়ামী লীগের একজন নেত্রী জিনাত সোহানা চৌধুরী বলেছেন, আওয়ামী লীগ যেহেতু টানা সরকারে রয়েছে, সেজন্য সুবিধা নিতে বিভিন্ন দল থেকে লোকজন ভিড় করছে তাদের দলে।এই নব্যদের অনেকের নানান অপরাধের কারণে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
“আওয়ামী লীগ যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় আছে, এখানে হাইব্রিডদের অনুপ্রবেশ আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে আমি বলবো। কারণ দেখা যাচ্ছে, অনেকে আওয়ামী লীগের বদনাম করার জন্য, অনেকে আছে চেহারাটা পাল্টিয়ে নব্য আওয়ামী লীগার হয়ে বিভিন্ন কাজ করে আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলছে। যারা দীর্ঘ সময় ধরে রাজনীতি করে যাচ্ছে, তারা অনেক সময় হাইব্রিডদের কারণে অবহেলিত হয়।”
গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন দল থেকে যারা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন, তাদের নিয়ে অনুপ্রবেশকারি বা হাইব্রিড- এই শব্দগুলো দলটিতে বেশ আলোচিত হচ্ছে।
দলটির সিনিয়র নেতারাও বিভিন্ন সময় এনিয়ে জনসমক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেছেন।অনেক জায়গায় নব্যদের সাথে পুরোনো নেতা কর্মিদের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে বলেও দলটির নেতাদের অনেকে বলেছেন।
উত্তরের একটি বিভাগীয় শহর রাজশাহী থেকে আওয়ামী লীগের একজন নেত্রী পূর্ণিমা ভট্টাচার্য বলছিলেন, পরিস্থিতির কারণে তৃণমুলে তাদের মাঝে অনেক সময় হতাশাও তৈরি করছে।
“অনুপ্রবেশকারি বা হাইব্রিড নামে যে কথাটা প্রচলিত হয়েছে বা তারা যে আসছে,এরা এসে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে এবং অনেক ক্ষতি করছে। আমরা যারা দীর্ঘ সময় ধরে দল করি, তারা প্রতি পদে পদে এটা অনুভব করছি।”
তবে বছর খানেক আগে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে যুদ্ধাপরাধী কেউ বা জামায়াতে ইসলামীর কেউ যেনো তাদের দলে যোগ দিতে না পারে।
এছাড়া অন্য দলগুলোর কেউ আওয়ামী লীগে যোগ দিতে চাইলে তার অতীত যাচাই করে দেখার নির্দেশ ছিল দলটির সব পর্যায়ের নেতা কর্মিদের প্রতি।দলটির শীর্ষ পর্যায় থেকেই এই নির্দেশ ছিল।কিন্তু এর বাস্তবায়ন হয়নি বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদেরই অনেকে।
আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফও বলেছেন, “আমরা দূর্ভাগ্যজনকভাবে লক্ষ্য করেছি যে, বিভিন্ন সময় বিশেষ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন কেন্দ্র করে বিভিন্ন দল থেকে এসে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বা বিদ্রোহী প্রার্থীর সাথে ভিড়েছেন।”
মি: হানিফ আরও বলেছেন, বিভিন্ন দল থেকে যারা এসেছেন, তাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেয়ার পর ইতিমধ্যে সারাদেশে এই তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে যে কোথায় কে কোন দল থেকে যোগদান করলো। সেটাকে যাচাই বাছাই করার জন্য একটি কমিটি করা হযেছে। সেই কমিটি কাজ করছে।”
আওয়ামী লীগের এই নেতা আরও জানিয়েছেন, তালিকা যাচাই করে যাদের সাথে আওয়ামী লীগের রাজনীতির ফারাক পাওয়া যাবে, তাদের দল থেকে বের করে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি উল্লেখ করেছেন, দলের যারা তাদের প্রশ্রয় দিয়েছে, তাদের ব্যাপারেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচবি