বাংলা৭১নিউজ,রিপোর্ট: কেউ বলছেন ‘উচ্চাভিলাসী’; আবার কারো মতে ‘বাস্তবমুখী’ পরিকল্পনা। বিশেষণ যাই হোক- ‘বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার (নতুন ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম)’ প্রকল্পের কাজটি যথাসময়ে বাস্তবায়ন হোক এটি সকলেরই প্রত্যাশা। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ১৬২ কিলোমিটার পারি দিয়ে যমুনা নদীর পানি আসবে বুড়িগঙ্গায়। বাড়তি ফসল উৎপাদসসহ বহুমুখি সুবিধা সম্বলিত এই প্রকল্পটির সম্পূর্ন বাস্তবায়ন নির্ভর করছে অর্থনৈতিক যোগানের ওপর। অতিতেও অর্থের অভাবে প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছিল। যার ফলে ২০০৮ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পটি এখনও শেষ হয়নি। এক যুগ আগে এই প্রকল্পটির যেখানে ব্যয় ছিল ৯৮৮ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। আর কাজ সমাপ্তির সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২২ সালের জুন।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের তাগিদ থাকলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অর্থের টানাপেডাড়েন সেই পূর্বের মতই রয়ে গেছে। দশ বছরে ভূমি অধিগ্রহণ, ভৌত কাজ, ড্রেজিং বাবদ এই প্রকল্পের পেছনে ৪২৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রকল্পটি যথাসময়ে বাস্তবায়ন করতে হলে বাকি ২ বছরে প্রয়োজন ৭৫০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে বছরে লাগবে ৩৫০ কোটি টাকা। জানা গেছে, চলতি বছর এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ১২০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে অর্থের ঘাটতি রয়েছে ২৩০ কোটি টাকা। এই অর্থ বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্ত বরাদ্দ এখনও মেলেনি। এছাড়াও প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পর এর রক্ষনাবেক্ষনের জন্যও প্রয়োজন হবে বছরে ৭২ কোটি টাকা। অন্যথায় এর সুফল পাওয়া যাবে না।
ঢাকার নগরবাসীকে দূষণমুক্ত বুড়িগঙ্গা উপহার দেওয়ার জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও পানির রং কালচে আকার ধারণ করে ছড়াচ্ছে পচা দুর্গন্ধ। অনেকের মতে, বুড়িগঙ্গার পাড় দিয়ে চলাচল করাই দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, শীতকালে এর পানি থেকে প্রচন্ড দুর্গন্ধ ছড়ায়। এতে সৃষ্টি হচ্ছে নানা রোগজীবাণু। দীর্ঘদিন পানি আটকে থাকায় ক্রমেই এর রং কালো হয়ে পড়ছে। যদিও কখনো ড্রেজিং, কখনো হাজারীবাগের ট্যানারি স্থানান্তর করার মাধ্যমে বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্ত এতে কাঙ্খিত সুফল আসেনি। যার ফলে ‘বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার (নতুন ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম)’ প্রকল্পটি নতুনভাবে গৃহিত হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে-অর্থনীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও তুরাগ ও পুংলি নদী। কৃষিখাতে পড়বে এর ইতিবাচক প্রভাব।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ৬৯ হাজার ২৬৭ মেট্রিক টন অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন হবে। মৎস্য উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গার পানি দূষণমুক্ত ও নাব্যতা সংকট থেকে উত্তরণের জন্য যমুনা থেকে ২৪৫ কিউমিক পানি আসবে বুড়িগঙ্গায়। এই ব্যবস্থা কার্যকর করতে যমুনার প্রধান উৎসমুখের অবস্থান পরিবর্তন অথবা বঙ্গবন্ধু সেতুর (যমুনা বহুমুখী সেতু) উজানে নতুন উৎসমুখ নিউ ধলেশ্বরীর সাথে যমুনার সংযোগের মাধ্যমে পানি সংগহ করা হবে। বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধে পানির প্রবাহ বৃদ্ধিসহ শিল্প ও বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণের ওপর এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
যমুনা থেকে বুড়িগঙ্গার দূরত্ব মোট ১৬২ কিলোমিটার। এর মধ্যে ধলেশ্বরী দুই, পুংলী ৬১ দশমিক ৫০, বংশাই ২০ দশমিক ৫০ ও তুরাগ নদীর দৈর্ঘ্য ৭৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার। এসব নদীর অফটেকের উৎসমুখের স্থানটি ভাটিমুখী যমুনার প্রবাহের সঙ্গে সমন্বয় করে সামান্য পরিবর্তন করা অথবা অবস্থানের স্থানান্তর করে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি, চক্রাকার নৌপথ ও বুড়িগঙ্গার পানি সহনীয় মাত্রায় দূষণমুক্ত করা যেতে পারে।
বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে তিন কিলোমিটার ভাটিতে নিউ ধলেশ্বরী নদীর বর্তমান উৎসমুখের অবস্থান। উৎসমুখটি বিগত বর্ষায় যমুনা নদীবাহিত পলিতে ভরাট হয়ে গেছে। এটি খনন করেই ধলেশ্বরী হয়ে বুড়িগঙ্গায় যমুনা নদীর পানি প্রবাহ বাড়ানো হবে। পানি প্রবাহ বাড়ানো কারণে যমুনা থেকে যে পরিমান বালি আসবে তা রোধ করারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এজন্য একটি সেডিমেন্ট বেসিন তৈরি করা হবে। এই সেডিমেন্ট বেসিন, ইনটেক চ্যানেল ও সেডিমেন্ট বেসিনের বাইরে বছরে গড়ে ৫ লাখ ৬৫ হাজার ২৩৫ ঘনমিটার সেডিমেন্ট জমা হবে। জমা সিল্ট ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অপসারণ ও তা বিক্রি করা যাবে। তবে যমুনার পানি ধলেশ্বরিতে প্রবেশ করাতে হলে ভাটিতে যমুনা নদীর বাম তীরের কাছে ডুবোচর ড্রেজিং করে নাব্যতা পুনরুদ্ধার করা জরুরি বলে বিশেষজ্ঞদেও অভিমত।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা জোনের প্রধান প্রকৌশলী অখিল কুমার বিশ্বাস জানান, দূষণমুক্ত বুড়িগঙ্গার জন্য আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছি। এর ধারাবাহিকতায় কয়েকটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সব প্রতিবেদনে একটা বিষয় বারবার সামনে এসেছে, ঢাকাবাসীকে দূষণমুক্ত বুড়িগঙ্গা উপহার দিতে হলে যমুনার পানি বুড়িগঙ্গায় আনতে হবে। আর এর মাধ্যমে পানিপ্রবাহ বাড়াতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন দীর্ঘায়িত না করে নির্ধারিত মেয়াদেও মধ্যেই এর কাজ সমাপ্ত করা দরকার। পুংলীর ভাঙন কবলিত স্থানগুলোতে নদীর তীর সংরক্ষণ, নদী প্রশস্ত করার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ, নদী ও সেডিমেন্ট বেসিনের রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং ইত্যাদি কাজ দ্বিতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বুড়িগঙ্গার পানিদূষণ ও নাব্যতা সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রকল্পের প্রধান উৎসমুখে পানিপ্রবাহ আনুপাতিক হারে বাড়াতে হবে। কয়েক দশক ধরে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর পানিপ্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।যেখানে-সেখানে নৌযান নোঙ্গর, নদীর তীর দখল, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের কারণে জলপথ সরু হয়েছে। শিল্প-কারখানাগুলো থেকে নোংরা তরলের সঙ্গে বিষাক্ত রাসায়নিকের ক্রমাগত নিঃসরণ এবং নদী ও খালগুলোতে পলিথিনসহ নানাবিধ মানববর্জ্য নিক্ষেপের ফলে এগুলোর তলদেশ ভরাট হচ্ছে।
অখিল কুমার বিশ্বাস বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় দেখা গেছে- ধলেশ্বরী নদীর উৎসমুখে যমুনা নদী থেকে পানি প্রবেশ করার পথ প্রতিনিয়ত বালি ও পলি পড়ে ভরাট হয়ে যায়। ফলে, নতুন নতুন চর সৃষ্টি হচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪০ কিলোমিটার ড্রেজিং কাজ বাস্তবায়নের পর শুষ্ক মৌসুমে যমুনা নদী থেকে ধলেশ্বরী হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রবাহ শুরু হয়। কিন্তু, পরবর্তীকালে তা আবারও ভরাট হয়ে যায়।বুড়িগঙ্গায় পানি প্রবাহ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও আর্থ-সামাজিক কার্যক্রম বৃদ্ধির সঙ্গে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের অভ্যন্তরীণ বন্দরগুলোর পরিধি, শিল্প ও ব্যবসাকেন্দ্র ব্যাপকভাবে বেড়েছে। পানি স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারছে না। ফলে, বুড়িগঙ্গায় পানিপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। এছাড়াও পলি ভরাটের কারণে শুষ্ক মৌসুমের উৎস নদী যমুনার সঙ্গে নদীবলয়ের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে পানিপ্রবাহ কমে যায়। যমুনা থেকে পানির প্রবাহ কমায় ফিডার নদীগুলো শুকনো মৌসুমে প্রায় নাব্যশূন্য থাকে। এই নব্যতা ফেরাতে হলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে যমুনা থেকে ২৪৫ কিউমেক পানি এনে বুড়িগঙ্গায় ফেলতে হবে।
ঢাকা জোনের প্রধান প্রকৌশলী অখিল কুমার বিশ্বাস।
অখিল কুমার বিশ্বাস আরও বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পাশাপাশি এর রক্ষনাবেক্ষনের জন্য প্রতিবছর ৭২ কোটি টাকা বরাদ্ধ রাখতে হবে। যাতে করে এই চ্যানেল সচল রাখা যায়। অন্যথায় চ্যানেলটি ভরাট হয়ে যাবে এবং পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হবে। ফলে কাঙ্খিত সুপল আসবে না। তিনি বলেন, অত্যন্ত ভাল ও বহুমুখি সুবিধা সম্বলিত এই প্রকল্পটির ভবিষ্যত নির্ভর করছে চাহিদা মোতাবেক অর্থ প্রাপ্তির ওপর।
কিভাবে যমুনার পানি বুড়িগঙ্গায় নেবেন? জানতে চাইলে অখিল কুমার বিশ্বাস বলেন, যমুনা থেকে নতুন ধলেশ্বরী, পুংলী, বংশাই, তুরাগ নদী হয়ে নৌ-পথে বুড়িগঙ্গায় পৌঁছাবে এই পানি। এসব নৌ-পথের গভীরতা নিশ্চিত করা হবে। এছাড়াও এসব নদীর পানির প্রবাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে সেচ ও মৎস উন্নয়ন এবং সামাজিক ও পরিবেশগতউন্নয়নকে এগিয়ে নেয়া হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে শুষ্ক মৌসুমে এসব নদীতে নব্যতা থাকবে। প্রকল্পটি শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুর ২ কিলোমিটার ভাটিতে নতুন ধলেশ্বরী নদীর উৎসমুখ থেকে। এখানে নতুন ধলেশ্বরী নদী পলি পড়ে যমুনা থেকে উঁচু হয়ে গেছে। এজন্য ৬ থেকে ৭ মিটার গভীর পর্যন্ত নতুন ধলেশ্বরী নদীর খনন কাজ চালাতে হবে। প্রায় আড়াই কিলোমিটার খননের পর নতুন ধলেশ্বরী এসে মিলবে পুংলী নদীর সাথে। একই গভীরতায় পুংলী নদীর ৬২ কিলোমিটার, বংশী নদীর ২১ কিলোমিটার এবং তুরাগ নদীর ৭৮ কিলোমিটার খনন করতে হবে।
তিনি বলেন, এই কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরই শুষ্ক মৌসুমে যমুনা থেকে নতুন ধলেশ্বরী দিয়ে ৮ হাজার ৬৪৮ কিউসেক পানি প্রবেশ করবে। এই পানির পরিমাণ তুরাগের উৎসমুখে এসে দাঁড়াবে ৬ হাজার ২১২ কিউসেক। তুরাগ নদী থেকে ১২শ’ কিউসেক পানি ব্যবহার হবে সেচ কাজে। তুরাগ থেকে ১ হাজার ৩৩৫ কিউসেক পানি চলে যাবে বংশী ও বংশী দক্ষিণ নামক নদীতে। আর ৫ হাজার ৭১৯ কিউসেক পানি সব সময় সচল রাখবে টঙ্গী খাল ও তুরাগ নদীকে।সবশেষে বুড়িগঙ্গায় যেয়ে পৌঁছবে ৪ হাজার ৯৭৭ কিউসেক পানি। প্রকল্পের ১৬৩ কিলোমিটারের মধ্যে ৬২ দশমিক ৫০ কিলোমিটার নদী খনন হবে এস্কাভেটর (মাটি খননযন্ত্র) দিয়ে। এরপর পুনরায় ১৬৩ কিলোমিটার নদীর পুরোটাই ড্রেজার (নদী খননযন্ত্র) দিয়ে খননকরা হবে।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে এই প্রকল্পের সমীক্ষা চালানো হয়। ২০১০ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া প্রকল্পের মূল ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুযায়ী প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৯৪৪ কোটি টাকা। প্রকল্পটি প্রথম সংশোধন করে মোট ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরবর্তিতে এই সময় বাড়িয়ে ২০২২ এর জুলাই করা হয়েছে।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচবি