মোড়কজাত পণ্যের ক্ষেত্রে শুধু মূল পণ্যের শুল্ক পরিশোধ করেই এতদিন আমদানি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা। এখন থেকে মোড়কের জন্যও শুল্ক-কর দাবি করছে কাস্টম হাউজ। সম্প্রতি জারি করা প্রজ্ঞাপনে মোড়কসহ পণ্য শুল্কায়নের এ নির্দেশ দিয়েছে এনবিআর।
নির্দেশনা অনুযায়ী, আমদানিকৃত যেসব পণ্য মোড়কসহ (প্যাকেট, বোতল, জার কিংবা অন্যান্য ম্যাটেরিয়াল) বাজারজাত হয়, তার মূল্য বিবেচনায় নিয়ে (গ্রস ওয়েট) শুল্কায়ন করতে হবে। গ্রস ওয়েট বলতে পণ্য (কন্টেন্টস) ও এর সঙ্গে মোড়কের (বোতল, টিনের কনটেইনার, কাগজের প্যাকেট ও স্টিল, আয়রন, গ্লাস, অ্যালুমিনিয়ামসহ যেকোনো প্যাকিং ম্যাটেরিয়াল) ওজন বোঝানো হয়।
যুক্তি হিসেবে এনবিআর বলছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের মতো দেশ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পন্থায় শুল্কায়ন করে আসছে। বাংলাদেশও চর্চাটি চালু করতে যাচ্ছে। এনবিআরের হিসাবে, এর মাধ্যমে বছরে দেড় হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব আহরিত হবে।
এনবিআর সদস্য (কাস্টমস নীতি) মো. লুত্ফর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, মোড়কসহ পণ্য আমদানির পর বাজারে শুধু পণ্যই বিক্রি হচ্ছে না, বরং তার সঙ্গে প্যাকিং ম্যাটেরিয়ালও বিক্রি হয়। তাই মোড়কেরও শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। তবে যে মোড়ক পণ্যের সঙ্গে বাজারে বিক্রি হবে না, তাতে আমরা শুল্কারোপ করছি না।
এনবিআরের এ যুক্তি মানতে রাজি নন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন হলে আমদানি পণ্যে ব্যবসায়ীদের ব্যয় বেড়ে যাবে। বিভিন্ন ধরনের পণ্য, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে স্থানীয় বাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, পণ্যের সঙ্গে মোড়কের মূল্য বিবেচনায় নিয়ে শুল্কায়ন হলে বাজার ব্যবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বেশি। এনবিআরের এ অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আশা করব, এনবিআর দ্রুত এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। অর্থবছরের প্রথমার্ধের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ কোটি টাকা। এনবিআর সূত্রগুলো বলছে, এর বিপরীতে আহরণ হয়েছে ৮৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থাত্ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে আছে এনবিআর।
এ ঘাটতি পূরণে রাজস্বের নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করার অংশ হিসেবে বন্দরের সব ধরনের সেবা মাশুলের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট পরিশোধে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে এনবিআর। বর্তমানে বন্দরের ২৫ ধরনের সেবা মাশুলের ওপর ভ্যাট আদায় করলেও এখন থেকে ৬০ ধরনের সেবার ওপরই তা আদায় করতে চায় সংস্থাটি।
আমদানি-রফতানিতে বন্দর খরচ ১৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এর বিরোধিতা করেছে খোদ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এনবিআরের এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন ব্যবসায়ীরাও। যদিও এর ফলে ২০০ কোটি টাকার মতো অতিরিক্ত আসবে বলে মনে করছে রাজস্ব আহরণকারী সংস্থাটি।
অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে করারোপ করলে ব্যবসায়ীরা চাপে পড়েন মন্তব্য করে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, বাংলাদেশে কর জিডিপি অনুপাত অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। রাজস্ব বাড়াতে এনবিআরের উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাব। তবে যারা নিয়মিত কর দেন, তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে। অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে করারোপ করলে ব্যবসায়ীদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়। সারা দেশে করজাল বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি একটি নির্দিষ্ট রাজস্বনীতি প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছি আমরা।
বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের কাছ থেকে কর আহরণ বাড়াতে বহুজাতিক ও স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভিযানও চালাচ্ছে এনবিআর। ছয়টির মতো প্রতিষ্ঠানে অভিযান এরই মধ্যে শেষ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও অভিযান চালাবে সংস্থাটি। এর মাধ্যমে প্রায় ৫০ হাজার বিদেশী করদাতা পাওয়ার আশা করছে এনবিআর।
নতুন ক্ষেত্র হিসেবে রেলওয়ের মাধ্যমে পেট্রোলিয়ামজাতীয় পণ্য পরিবহনে ৪ দশমিক ৫ ও অন্যান্য পণ্যে ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের কথাও ভাবছে এনবিআর।
অর্থবছরের মাঝামাঝি এ ধরনের সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ীদের পরিকল্পনা ব্যাহত হয় বলে মন্তব্য করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ।
তিনি বলেন, আমরা সবসময়ই ব্যবসায়ীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে রাজস্ব আহরণের কথা বলি। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে এমনিতেই আমদানি ব্যয় বেড়েছে। দেশে কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস ব্যয়ও অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। বছরের মাঝামাঝি সময়ে নতুন করে করারোপ করা হলে ব্যবসায়ীদের পরিকল্পনা ব্যাহত হবে।
বাংলা৭১নিউজ/সূত্র:বণিক বার্তা/এসএস