বিতর্কিত নানা পরিচয়ের মধ্যে মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার বিশেষ উত্তাপ ছড়াতে আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাকারবারে নাম লেখান। যার এক একটি অস্ত্রের দাম ছিল কোটি টাকার উপরে। স্বর্ণের প্রলেপযুক্ত সর্বাধুনিক উজি পিস্তল কেনাবেচায় নেমে পড়েন তিনি। এটিই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ গোয়েন্দা ফাঁদে ধরা পড়ে তার এই ভয়াবহ কারবার। এছাড়া তার প্রভাবশালী তালিকার সবচেয়ে বড় দক্ষিণহস্ত সম্প্রতি বেকায়দায় থাকায় পিয়াসা নিজেকে শেষ রক্ষা করতে পারেননি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পিয়াসার মাধ্যমে আমদানি নিষিদ্ধ উচ্চ ক্যালিবারের মূল্যবান অস্ত্র কেনাবেচা শুরু হয় কয়েক বছর আগে। জানা যায়, বনানী ক্লাব ছাড়াও পিয়াসার পার্টি হয় ফ্লোর সিক্স ও মিন্ট আল্ট্রা লাউঞ্জ নামের সিসা বারে। জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে আয়োজিত পার্টিতে ভিআইপিদের আড্ডা জমত। প্রায় প্রতি পার্টিতে মিশু নামের এক যুবকের সঙ্গে পিয়াসাকে ঘনিষ্ঠ দেখা যায়। কোটিপতি মিশু বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। টেক্সাসে তার বাড়ি রয়েছে।
পিয়াসার বন্ধু হিসাবে পরিচিত মিশু বেশিরভাগ সময় বিদেশে থাকলেও ঢাকায় তার শুল্কমুক্ত চোরাই গাড়ির ব্যবসা রয়েছে। বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ ও রেঞ্জ রোভার ব্র্যান্ডের গাড়ি বিক্রি করেন মিশু। প্রভাবশালীদের সন্তানরা এসব গাড়ির ক্রেতা। ব্যবহার হয় ভুয়া নম্বর প্লেটে। এছাড়া ডেইরি সান নামে একটি গরুর খামারে বিনিয়োগ রয়েছে পিয়াসার। তবে খামারের আড়ালে মাদক চোরাচালানের অভিযোগ আছে। এছাড়া ফ্লোর সিক্সের মালিক সাঈদের সঙ্গে পিয়াসার ঘনিষ্ঠতা ওপেন সিক্রেট। নরসিংদীর বাসিন্দা সাঈদ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হলেও ঢাকার শোবিজ জগতে তিনি ব্যাপক পরিচিত। ক্ষমতার বলয়ে তার ওঠাবসা। এছাড়া রাজধানীর গুলশানে হোটেল আমারিতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল পিয়াসার। সেখানে তার সঙ্গে ক্যাসিনো কারবারে জড়িত কয়েকজন যুবলীগ নেতাকেও দেখা যায়। আমারি হোটেলের লবিতে পিয়াসার সঙ্গে একই টেবিলে আড্ডায় মত্ত এক এমপির ছবি ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিয়াসার ঘনিষ্ঠভাজনদের নামের তালিকা বেশ লম্বা। প্রভাবশালীদের অনেকেই রয়েছেন তার বন্ধু কিংবা বয়ফ্রেন্ডের তালিকায়। পিয়াসার ঘনিষ্ঠভাজনদের মধ্যে সবার উপরে আছে একটি শিল্প গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার। যাকে সবাই এক নামে চেনেন। তার সঙ্গে পিয়াসার ঘনিষ্ঠ একাধিক ছবি ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। পিয়াসার সঙ্গে তার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এ কারণে বানানী ক্লাবে গেলে গভীর রাতেও পিয়াসার জন্য বার কাউন্টার খোলা হয়।
এছাড়া তার বন্ধু তালিকায় নাম আছে জনৈক জামান, রানা ওরফে শফিউল্লাহ, একটি বিদ্যুৎ প্লান্টের মালিকের ছেলে সাইফ, জঙ্গি কানেকশনে বন্ধ হয়ে যাওয়া লেকহেড স্কুলের মালিক খালেদ, ইয়াবা ডন শালেহ চৌধুরী ওরফে কার্লোস, এক শিল্পপতির নাতি ফাহিম, চট্টগ্রামের গাড়ি ব্যবসায়ী রুবায়েত খান, কাকরাইলের একটি বড় আবাসিক হোটেলের মালিকের ছেলে রাজিব, চেক জালিয়াতির মামলায় কারাবন্দি জাতীয় পার্টির নেতা শাফিউল্লা মনির, বিএনপি নেতা এসএস খালেকের ছেলে সাজু ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাতিজা সাকের কাদের চৌধুরী। এছাড়া খুলনা থেকে আসা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শাহরিয়ার ওরফে শেখ শাহরিয়ারের সঙ্গে পিয়াসার ঘনিষ্ঠতা দেখা যায়। তাদের দু’জন হোটেল ওয়েস্টিনে পার্টি শেষে গভীর রাতে লং ড্রাইভে বের হতেন।
জানা যায়, বারিধারা আবাসিক এলাকার ৯ নম্বর রোডের একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া থাকতেন পিয়াসা। সার্ভিস চার্জ ও সিকিউরিটি বিল বাদে শুধু ফ্ল্যাট ভাড়া ৩ লাখ টাকা। অথচ দৃশ্যমান কোনো আয় নেই পিয়াসার। বিশাল ফ্ল্যাটে তিনি একাই থাকেন। তার রান্নাবান্নাসহ ব্যক্তিগত কাজের জন্য কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শাহজাহান নামের এক বাবুর্চি তার ফ্ল্যাটে রান্নার কাজ করেন।
বলাবাহুল্য পিয়াসার ফ্ল্যাটে প্রভাবশালীদের যাতায়াত ছিল বাধাহীন। করোনায় পাঁচতারকা হোটেলগুলো বন্ধ হয়ে গেলে নিয়মিত পার্টি হতো তার ফ্ল্যাটেই। ইয়াবা ও মদ পানের সব আয়োজন থাকত রেডি। কোটি টাকা মূল্যের দুটি ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন পিয়াসা। এর একটি বিএমডব্লিউ এবং অন্যটি মাজদা ব্র্যান্ডের। এছাড়া তার আরও একটি লাল রংয়ের ফেরারি রাখা হয়েছে গুলশান-২ এর একটি শোরুমে। ৬ হাজার সিসির গাড়িটি বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজছিলেন পিয়াসা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিুবিত্ত পরিবারের মেয়ে পিয়াসা বড় হয়েছেন চট্টগ্রামে। নগরীর আজগর দিঘি লেনে তাদের বাড়ি। বাবার নাম মাহবুব আলম। তিনি কাস্টমসের কর্মচারী ছিলেন। বর্তমানে তিনি গুরুতর অসুস্থ। পিয়াসার শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাশ হলেও নিজেকে কখনো এমবিএ, আবার কখনো ব্যারিস্টার বলে পরিচয় দিতেন। কথায় কথায় বলতেন তিনি ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সাবেক ছাত্রী। অথচ পিয়াসা চট্টগ্রামের খাস্তগির স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশের পর আর লেখাপড়া করেননি। তিন বোনের মধ্যে একমাত্র পিয়াসা থাকেন ঢাকায়।
সূত্র বলছে, চট্টগ্রামের আলী এন্টারপ্রাইজের মালিকের ছেলের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে ১৫ বছর আগে ঢাকায় পা রাখেন পিয়াসা। নানা জায়গায় চাকরির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের কর্মকর্তা মিজানের সঙ্গে তার সখ্য হয়। মিজান তাকে বিয়ে না করলেও অনেকেই তাদেরকে স্বামী-স্ত্রী বলে জানত। এ সময় পিয়াসা নিজেকে সংশ্লিষ্ট টেলিভিশনের পরিচালক বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন। এরই সূত্র ধরে হাই সোসাইটিতে পরিচিত হয়ে ওঠেন পিয়াসা। এর পরের দিনগুলো রীতিমতো ইতিহাস। একে একে পিয়াসার বন্ধু তালিকায় যোগ দেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা।
এক পার্টিতে পিয়াসার সঙ্গে পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা হয় স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ী আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদের। শেষ পর্যন্ত সাফাত তাকে বিয়ে করেন। কিন্তু দাম্পত্য বেশিদিন টেকেনি। ২০১৭ সালে পিয়াসাকে ডিভোর্স দেন সাফাত। কিন্তু ডিভোর্স মেনে নিতে পারেননি পিয়াসা। তিনি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন।
বনানী রেইনট্রি হোটেলের ধর্ষণ কাণ্ডে সাফাতের নাম জড়িয়ে গেলে দৃশ্যপটে পিয়াসার আবির্ভাব ঘটে। মামলার দুই বাদীকে নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠেন তিনি। এক পর্যায়ে আপন জুয়েলার্সের মালিকের সঙ্গে মোটা অংকের অর্থ চেয়ে দর কষাকষি শুরু করেন পিয়াসা। অতিষ্ঠ হয়ে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করেন আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিম। মামলাটি এখনো চলমান। অবশ্য সেলিমের বিরুদ্ধে গর্ভপাতের পালটা মিথ্যা মামলা দিতে ছাড়েননি পিয়াসা।
সূত্র বলছে, মাদক, নারী ও অস্ত্র ব্যবসা ছাড়াও বনানীর চাঞ্চল্যকর একটি হত্যাকাণ্ডে নাম জড়িয়ে যায়। ২০১৮ সালে বনানীতে খুন হন এসবি ইন্সপেক্টর মামুন। জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে ডিজে পার্টিতে ডেকে নিয়ে তাকে খুন করা হয়। এ ঘটনায় পিয়াসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। কিন্তু পিয়াসা সহজেই পুলিশি ঝামেলা এড়িয়ে যেতে সক্ষম হন। কারণ আলোচিত ডিআইজি মিজানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে পিয়াসা পুলিশি তদন্ত পাশ কাটিয়ে যান।
সূত্র জানায়, ডিআইজি মিজানের সঙ্গে বিশেষ সখ্যের কারণে তিনি ব্যক্তিস্বার্থে ইচ্ছামতো থানা পুলিশকে ব্যবহারের সুযোগ কাজে লাগান। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে অনেককে হেনস্তা করতেন তিনি। পিয়াসার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন ইডেন ডি সিলভা নামের শোবিজ তরুণী। তার অপরাধ ছিল পিয়াসার কথামতো কাজ করতে রাজি হননি তিনি। এছাড়া পিয়াসার ফাঁদে পড়ে মাদকের জগতে জড়িয়ে যান এক শিল্পপতির মেধাবী কন্যা নাজিবা। রাজধানীর আইএসডি স্কুলের ছাত্রী নাজিবা ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েন। পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয় তাকে। কিন্তু মাদকের অভিশপ্ত জীবন তার পরিবারকে লন্ডভন্ড করে দেয়।
বাংলা৭১নিউজ/এবি