বাংলা৭১নিউজ,(দিনাজপুর)প্রতিনিধি: দিনাজপুরে খানসামা ও বীরগঞ্জে চারটি ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় ৫০০ একর জমির উঠতি বোরো ধান নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু ধান নয়, আম, লিচু, কলা, ভূট্টাসহ বিভিন্ন গাছ নষ্ট হয়েছে। সেইসঙ্গে বিষাক্ত ধোঁয়ায় মারা গেছে প্রায় খামারের ৩ শতাধিক মুরগি। এতে কষ্টার্জিত ধান, ফল গাছ এবং মুরগি হারিয়ে সর্বশান্ত হয়ে পড়েছে এলাকার মানুষ। তাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠেছে এলাকার পরিবেশ।
ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা জানিয়েছেন, ঋণ মাহাজন করে ইরি-বোরো ধান লাগিয়েছিলেন তারা। এখন উঠতি ধান নষ্ট হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন। সামনে ঈদ ও রোজায় কিভাবে চলবে, কিভাবে মহাজনের টাকা পরিশোধ করবে- এ নিয়ে চিন্তার শেষ নেই তাদের। ইটভাটার মালিকরা কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিলেও কৃষকেরা আদৌও ক্ষতি পূরণ পাবেন কি না এই নিয়ে দুঃচিন্তায় রয়েছেন।
এদিকে দু’উপজেলা নির্বাহী অফিসার ক্ষতিগ্রস্থ ধানের ক্ষেত পরিদর্শন করেছেন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও আশ্বাস দিয়েছেন।
দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার ৫নং ভাবকি ইউনিয়নের কুমড়িয়া গ্রামে এসএইচএস বিক্স ও টু স্টার বিক্স নামে দু’টি ইটভাটার বিষাক্ত ধোয়ায় প্রায় ৩০০ একর জমির ইরি-বোরো উঠতি ধান পাতান হয়ে সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে গেছে। এলাকায় আম, লিচু, কলা, ভুট্টাগাছ, বাঁশ ঝাড়, লিচু গাছ এমনকি একটি মুরগির খামারের ৩০০ মুরগি মারা গেছে। এলাকবাসীর অভিযোগ, ইটভাটা দু’টিতে খড়ি, কয়লার বর্জ্য আর টায়ার পুড়ানোর কারণে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে।
এলাকার তসলিম উদ্দিন জানান, বিষাক্ত ধোঁয়ায় পুঁইশাক কলা গাছসহ বাঁশ মরে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক আনোয়ার জানান, এনজিও’র কাছ থেকে অধিক লাভে টাকা নিয়ে ইরি-বোরো ধান লাগিয়েছি। কিন্তু ধান নষ্ট হওয়ায় এখন সামনের দিন কিভাবে যাবে, কিভাবে সংসার চলবে এ নিয়ে চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না। অপর কৃষক মোজাম্মেল হক জানান, হাঁস-মুরগি ও গাছ বিনষ্টের পাশাপাশি শ্বাস কষ্ট, হাঁপানিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এলাকার মানুষ।
ভাবকি ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম এ ঘটনায় কৃষকদের সঙ্গে থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি কৃষকদের ক্ষতিপুরণ উঠিয়ে দিতে ইউএনও’র সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। বলেন, শতাধিক ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের ক্ষতির অর্থ না পেলে আদালতের আশ্রয় নেবেন।
এদিকে খানসামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরকে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের ক্ষতির পরিমাণ নিরুপন করে তালিকা প্রস্তুত করার নিদের্শ দেয়, তিনি বলেন ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের ক্ষতি পূরন আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি পরিবেশ অধিদপ্তর গ্রামের মধ্যে কিভাবে ইটভাটার ছাড়পত্র দিল এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। প্রায় শতাধিক কৃষকের ৩০০ একর জমি ফসল নষ্ট হওয়ায় ইটভাটার ছাড়পত্র দেয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতি প্রশ্ন উঠেছে। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকেরা ক্ষতিপূরণ পাবে এমনটাই প্রত্যাশা উপজেলা প্রশাসনসহ সকলের। কৃষকেরা যাতে উঠে দাঁড়াতে পারে বা ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি পায়। তিনি বলেন ৩০০ একর ইরি-বোরো ধানের ফলন অনুযাযী ক্ষতির পরিমান প্রায় ৩ কোটি টাকার মত। এই পরিমাণ ক্ষতি দিবে কি না এ নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।
অন্যদিকে দিনাজপুরের বীরগঞ্জে দু’টি ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় প্রায় ২০০ একর ধানক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। এতে কপাল পুড়েছে দুই ইউনিয়নের শতাধিক কৃষকের। প্রতিবাদ করায় ভাটা মালিক মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে বলেও দাবি এলাকাবাসীর। বার বার ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় দ্রুত সময়ে কৃষি এলাকা হতে ইটভাটা সরিয়ে নেয়ার দাবিও জানান তারা ।
উপজেলার পাল্টাপুর ইউনিয়নের সাদুল্লাপাড়া গ্রামে আবাদি জমির ওপর স্থাপিত আরডিএফ ইট ভাটা এবং নিজপাড়া ইউনিয়নের নখাপাড়া গ্রামে এসবিএম ইট ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় শতাধিক কৃষকের জমির ধানক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক। এ দিকে কৃষি সম্প্রসারণের অফিসের পক্ষ থেকে পুড়ে যাওয়া ফসলে সাদাপানি ও ছত্রাক নাশক ওষুধ স্প্রে করার পাশাপাশি ইটভাটার গ্যাস যাতে অন্যান্য ফসলের ক্ষতি করতে না পারে সে ব্যাপারে পরামর্শ দিচ্ছে।
স্থানীয় কৃষকরা জানায়, ইট ভাটার বিষাক্ত ধোয়ায় আনুমানিক দুই’শ একর জমির বোরো ধান ও ভুট্টা ক্ষেত পুড়ে গেছে। বিষাক্ত ধোঁয়ার প্রভাব পড়েছে আম, কাঠাল, লিচুসহ বেশকিছু গাছে। এই বিষাক্ত ধোয়ায় ক্ষতি থেকে বাকি ফসল বাঁচাতে কৃষি অফিসের পরামর্শে কীটনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। এতে পুঁজি শেষ হলেও লাভ হচ্ছে না কৃষকের। এখন যদি ক্ষতিপুরণ না দেওয়া হয় তাহলে পথে বসতে হবে তাদের।
ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক পাল্টাপুর ইউনিয়নের সাদুল্লপাড়া গ্রামের মো. মজনু জানান, আবাদি জমির উপর স্থাপিত আরডিএফ ইট ভাটার চিমনি সেকেলের। এ কারণে প্রতিবছর ইট ভাটার বিষাক্ত ধোয়ায় ফসলের ক্ষেত পুড়ে যাচ্ছে। ইট ভাটা বন্ধের দাবি করেও কোন কাজ হয়নি। ববং গত বছরের ফসলের ক্ষতিপুরণের দাবি জানাতে গিয়ে ৪ জন কৃষকের বিরুদ্ধে ভাটা মালিকের পক্ষে চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করা হয়েছে ।
নিজপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. ওবাইদুল হক জানায়, কৃষি জমি নষ্ট করে ইট ভাটা নির্মাণে বাঁধা দেয়া হয়। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির বলে সেখানে ইট ভাটা স্থাপিত হয়েছে। সে সময় বাঁধা দেয়ার কারণে আমাকে বিভিন্ন ধরণের হুমকি প্রদান করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে আমি আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি।
আরডিএফ ইট ভাটার ম্যানেজার মো. আবদুল মান্নান জানান, গত বছর ইটভাটার কারণে ফসলের ক্ষতি হয়েছিল, কিন্তু ভাটা মালিক প্রত্যেক কৃষকে ক্ষতিপুরণ প্রদান করেছেন। তবে এবার কি কারণে ফসলের ক্ষতি হয়েছে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বাংলা৭১নিউজ/এলএ.এফএ